হরতাল পলিসি ফর বাংলাদেশ। ব্রিটিশ কাউন্সিল সারা পৃথিবীতেই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিচ্ছে একই সময়ে—সাধারণত যা ‘ও-লেভেল’ আর ‘এ-লেভেল’ পরীক্ষা বলে পরিচিত। সারা পৃথিবীর সব দেশের জন্যই তারা একটা পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করেছে। শুধু বাংলাদেশের জন্য তাদের অতিরিক্ত নিয়ম যুক্ত করতে হয়েছে সেই রুটিনে। তাদের রুটিনে লেখা আছে: হরতাল পলিসি ফর বাংলাদেশ।
পলিসিটা বেশ বড়সড়। মোদ্দা কথা হলো, যদি ১২ ঘণ্টা হরতাল হয়, তাহলে দুপুরের পরীক্ষা সন্ধ্যার পরে, আর বিকেলের পরীক্ষা রাত ১২টায় শুরু হবে। আর হরতাল যদি ২৪ ঘণ্টার হয়, তাহলে এবারের পরীক্ষা বাতিল, সামনের বছর জানুয়ারিতে সেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
হ্যাঁ, পরীক্ষার দিনে হরতাল ডাকা হয়েছে। হাজারও পরীক্ষার্থী আর তাদের উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা মধ্যরাতে পরীক্ষার হলে গেছেন। বাচ্চাদের যখন ঘুমের সময়, চোখ রগড়ে তারা তখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, আর তাদের অভিভাবকেরা হলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে-বসে হাই তুলছিলেন।
পৃথিবীতে কত দেশ। কত বিচিত্র ধরনের মানুষ। এর মধ্যে একটা দেশই আছে, যারা নিয়মিতভাবে হরতাল করে। হরতাল জিনিসটা দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সর্বভারতীয় বন্ধ্ আজকাল আর ডাকা হয় বলে আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ্ আহ্বান করে থাকেন। ভারতের একটা-দুটো রাজ্যে বন্ধ্ ডাকা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা বছরে-দুবছরে এক-আধবার হতে পারে; নিয়মিতভাবে হরতাল, ‘লাগাতার হরতাল’, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হরতাল’, ‘অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত হরতাল’—এসব এই একুশ শতকে পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে অহিংস পথে পরিচালিত করার জন্য হরতাল নামের এই গুজরাটি শব্দটি চালু করেছিলেন। ব্রিটিশরা চলে গেছে, মহাত্মারাও আজকাল আর পৃথিবীতে জন্মান না, কিন্তু হরতাল জিনিসটা পৃথিবীর সব দেশ থেকে উঠে গিয়ে এই বাংলাদেশে এসেই স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে।
ভূমিকম্প কখন আসবে, পূর্বাভাস দেওয়ার যন্ত্র বা প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি। আকাশে মেঘ দেখা দিলে ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায়। সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস সময় থাকতেই দিয়ে দেওয়া যায়, লোকজন সরেও যেতে পারে। কিন্তু ওই সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের আগমন প্রতিরোধ করা যায় না। হরতাল আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। কিন্তু আমরা এখন শিখে গেছি, বলতে পারি, কবে হরতাল হবে। বিএনপির ৩৩ জন নেতাকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে, ফোনে একটা কথাই বলাবলি হয়েছে, হরতালটা কবে, বৃহস্পতিবার, নাকি রোববার? সবাই জানে, হরতাল অনিবার্য। কবে আর কত দিনের জন্য, সকাল-সন্ধ্যা নাকি তারও বেশি, এটাই ছিল প্রশ্ন। হরতালের দিনের চেয়ে হরতালের আগের বিকেলটা বেশি ভয়াবহ। কারণ, বিকেলে গাড়িতে আগুন দেওয়া হবে। গাড়িতে দু-চারজন যাত্রী, চালক জীবন্ত দগ্ধ হবেন। এটাও আমাদের জানা। সর্বশেষ হরতালের আগের দিনেও তা-ই হলো। রাত নয়টার দিকে একজন মুঠোফোনে কথা বলছেন, আমি শুনছি, ‘না, না, এত রাতে আর গাড়ি পোড়াবে না, টেলিভিশনের খবরগুলো হয়ে গেছে, পত্রিকার সাংবাদিকেরাও এখন রাস্তায় নেই, এত রাতে গাড়ি পোড়ানোর কথা নয়, আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসুন।’
কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগারে পাঠানোর আগের ঘটনা ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়া। এই পর্যায়ের একজন নেতাকে রাজপথ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে ড্রাইভারসমেত, তার গাড়ি পড়ে রইবে রাস্তায়, তার পরও বিরোধী দল চুপচাপ সেটা মেনে নেবে, এটা কেউ ভাবেনি। কাজেই দেশের মানুষ প্রস্তুত হয়েই ছিল, কবে হরতাল, কত দিনের জন্য হরতাল।
দেশের সাধারণ মানুষই বোঝে, কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় হরতাল আসবে। অথচ সরকার তা জানে না, তা হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। সেটা হাতে পাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান কেন সংশোধন করে ফেলা হলো, সেই বিস্ময় আমার যায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেওয়া হলে বিরোধী দলগুলো সেটা মানবে না, কাজেই তারা রাজপথে আন্দোলনে যাবে, সেটা যেকোনো বাচ্চা ছেলেও বোঝে। এই সংশোধনী তো সরকার তার ক্ষমতা-মেয়াদের একেবারে শেষ ভাগেও করতে পারত। তাড়াহুড়াটা কেন?
সরকারের নিশ্চয়ই অনেক সাফল্য আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতাও আসতে পারে। কিন্তু জেনেশুনে বিষপানের মতো ঘটনা একটার পর একটা কেন সরকার ঘটাচ্ছে, আমি অনেক চিন্তা করেও কোনো সমাধান পাই না। কতগুলো ইস্যু অপ্রয়োজনে তৈরি করে বিরোধী দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। যেসবের কোনো দরকারই ছিল না। ধরা যাক, বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধানে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এনে সমস্যার দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এটার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং তার কারণ নিয়ে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঢালাও অভিযোগ এনে তাঁদের গ্রেপ্তার করার পরিণতি কী হবে, সেটা কি সরকার বোঝে না? এই সিদ্ধান্তগুলো কে নিচ্ছেন? কীভাবে নিচ্ছেন?
সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপির আচরণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে। কারও পিএস টাকার থলি নিয়ে ধরা পড়েন, কারও বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে এবং সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। আচ্ছা, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না, কাজেই আমরা মালয়েশিয়া থেকে টাকা আনব, তাতে যদি সুদের হার বেশি দিতে হয়, সেই অতিরিক্ত টাকাটা কে দেবে? সরকারের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সেটা যদি কাল্পনিক আর বানোয়াটও হয়, তার দায় কেন জনগণ নেবে? সেই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করে সহজ শর্তে তহবিল সংগ্রহের দায়িত্ব সরকারের, পাবলিকের নয়।
কোনো এমপির গাড়িতে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়, কোনো এমপি জনতার উদ্দেশে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছেন, সেই ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সরকার ও প্রশাসনের চরম দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজে হতাশা প্রকাশ করেন। সর্বত্র দলীয়করণ, নিয়োগ-বাণিজ্য ও লুটপাট। এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ভূমিদস্যুতার। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর বিনিময়ে এমপি টাকা খান, লোক নিয়োগের নাম করে একই পদের বিপরীতে এলাকার একাধিক মানুষের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার অভিযোগ ওঠে এমপির বিরুদ্ধে। একদিকে দেশ চালাতে গিয়ে নানা সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতাগুলো যেমন প্রকট হয়ে উঠছে, তেমনি কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি বা পদস্থের আচার-আচরণ সরকার-সমর্থকদের মুখে চুনকালি মেখে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিরোধ মোকাবিলায় সরকারের আচরণ অসহিষ্ণু, নিপীড়নমূলক ও অগণতান্ত্রিক। বুঝতাম তা যদি কার্যকর হতো। মানে বলতে চাচ্ছি, দমন-নিপীড়ন করেও যদি সরকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারত, তবুও না হয় একটা সান্ত্বনা পাওয়া যেত। তা তো হচ্ছে না। নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এবং সরকারের একেকটা পদক্ষেপে তার জনপ্রিয়তায় একটা করে ধস নামছে।
যখন ব্যর্থতা আসে, তখন এমনি করেই আসে। একটার পর একটা ব্যর্থতার ঢেউ এসে আঘাত আনে। আর স্থানে স্থানে এমন সব কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে, মুখে চুনকালি পড়তে থাকে। তখন সরকারগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে, বাজে বকতে থাকে, দমনপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভাবতে থাকে, আমার মতো শক্তিশালী জগতে আর কেউ নেই। আমার মতো জনপ্রিয়ও পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কিন্তু পায়ের নিচের মাটি সরতে থাকে। তারপর যখন সরকারের পতন হয়, তখন সেটা হয় খুবই করুণ, খুবই শোচনীয়।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
এর মধ্যে রাজনীতিতে একটা সামান্য আশার আলো ফুটেছে। তা হলো, হরতালের বদলে বিরোধী দলের অনশন কর্মসূচিকে লোকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিও বলেছে, তারা হরতাল আহ্বান করতে চায় না। এই ছোট্ট আশাপ্রদ সূত্রটাকে ধরে উভয় পক্ষ কি এগিয়ে যেতে পারে না? সরকারের দিক থেকে সমঝোতার একটা চেষ্টা কি নেওয়া যায় না? রাজনৈতিক সমস্যার কোনো পুলিশি সমাধান নেই, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এটা না বোঝার মতো বোকা হতেই পারে না। সেখানেই আমাদের সামনে এক রহস্যময় ধাঁধা, রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি রাজনীতিকেরা নিচ্ছেন, নাকি অরাজনৈতিক কোনো উপদেষ্টা চক্রের হাতে পড়ে গেছে দেশ?
এই কলামের নাম ‘অরণ্যে রোদন’। কাজেই আমাকে অরণ্যে রোদন করে যেতেই হবে। রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে এগিয়ে আসুন। আরও দেড় বছর নির্বিঘ্নে দেশ চালনা করে সময়মতো নির্বাচন দিন। হরতাল আসতে পারে, এমন ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকুন।
আমি জানি, আমার এই কথা অরণ্যে রোদন মাত্র। একটা ভুল আরেকটা ভুল ডেকে আনে, একটা ভুল ঢাকার জন্য আরও ভুলের সিরিজ ডেকে আনা হয়।
আহা, এই দেশের সৃষ্টিশীল উদ্যমী মানুষগুলোর জন্য আমার কেবল মায়াই হয়, আফসোসই হয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কত বিরূপ, এর মধ্যেই কৃষকেরা বাম্পার ফসল ফলাচ্ছেন, শ্রমিকেরা-উদ্যোক্তারা-ব্যবসায়ীরা অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছেন, প্রবৃদ্ধি অর্জন করছেন। নিশাত মজুমদারেরা এভারেস্টে উঠে বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। আমাদের রাজনীতি যদি একটু মানুষবান্ধব হতো, আমরা কোথায় পৌঁছাতাম।
পলিসিটা বেশ বড়সড়। মোদ্দা কথা হলো, যদি ১২ ঘণ্টা হরতাল হয়, তাহলে দুপুরের পরীক্ষা সন্ধ্যার পরে, আর বিকেলের পরীক্ষা রাত ১২টায় শুরু হবে। আর হরতাল যদি ২৪ ঘণ্টার হয়, তাহলে এবারের পরীক্ষা বাতিল, সামনের বছর জানুয়ারিতে সেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
হ্যাঁ, পরীক্ষার দিনে হরতাল ডাকা হয়েছে। হাজারও পরীক্ষার্থী আর তাদের উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা মধ্যরাতে পরীক্ষার হলে গেছেন। বাচ্চাদের যখন ঘুমের সময়, চোখ রগড়ে তারা তখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, আর তাদের অভিভাবকেরা হলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে-বসে হাই তুলছিলেন।
পৃথিবীতে কত দেশ। কত বিচিত্র ধরনের মানুষ। এর মধ্যে একটা দেশই আছে, যারা নিয়মিতভাবে হরতাল করে। হরতাল জিনিসটা দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সর্বভারতীয় বন্ধ্ আজকাল আর ডাকা হয় বলে আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ্ আহ্বান করে থাকেন। ভারতের একটা-দুটো রাজ্যে বন্ধ্ ডাকা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা বছরে-দুবছরে এক-আধবার হতে পারে; নিয়মিতভাবে হরতাল, ‘লাগাতার হরতাল’, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হরতাল’, ‘অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত হরতাল’—এসব এই একুশ শতকে পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে অহিংস পথে পরিচালিত করার জন্য হরতাল নামের এই গুজরাটি শব্দটি চালু করেছিলেন। ব্রিটিশরা চলে গেছে, মহাত্মারাও আজকাল আর পৃথিবীতে জন্মান না, কিন্তু হরতাল জিনিসটা পৃথিবীর সব দেশ থেকে উঠে গিয়ে এই বাংলাদেশে এসেই স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে।
ভূমিকম্প কখন আসবে, পূর্বাভাস দেওয়ার যন্ত্র বা প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি। আকাশে মেঘ দেখা দিলে ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায়। সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস সময় থাকতেই দিয়ে দেওয়া যায়, লোকজন সরেও যেতে পারে। কিন্তু ওই সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের আগমন প্রতিরোধ করা যায় না। হরতাল আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। কিন্তু আমরা এখন শিখে গেছি, বলতে পারি, কবে হরতাল হবে। বিএনপির ৩৩ জন নেতাকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে, ফোনে একটা কথাই বলাবলি হয়েছে, হরতালটা কবে, বৃহস্পতিবার, নাকি রোববার? সবাই জানে, হরতাল অনিবার্য। কবে আর কত দিনের জন্য, সকাল-সন্ধ্যা নাকি তারও বেশি, এটাই ছিল প্রশ্ন। হরতালের দিনের চেয়ে হরতালের আগের বিকেলটা বেশি ভয়াবহ। কারণ, বিকেলে গাড়িতে আগুন দেওয়া হবে। গাড়িতে দু-চারজন যাত্রী, চালক জীবন্ত দগ্ধ হবেন। এটাও আমাদের জানা। সর্বশেষ হরতালের আগের দিনেও তা-ই হলো। রাত নয়টার দিকে একজন মুঠোফোনে কথা বলছেন, আমি শুনছি, ‘না, না, এত রাতে আর গাড়ি পোড়াবে না, টেলিভিশনের খবরগুলো হয়ে গেছে, পত্রিকার সাংবাদিকেরাও এখন রাস্তায় নেই, এত রাতে গাড়ি পোড়ানোর কথা নয়, আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসুন।’
কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগারে পাঠানোর আগের ঘটনা ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়া। এই পর্যায়ের একজন নেতাকে রাজপথ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে ড্রাইভারসমেত, তার গাড়ি পড়ে রইবে রাস্তায়, তার পরও বিরোধী দল চুপচাপ সেটা মেনে নেবে, এটা কেউ ভাবেনি। কাজেই দেশের মানুষ প্রস্তুত হয়েই ছিল, কবে হরতাল, কত দিনের জন্য হরতাল।
দেশের সাধারণ মানুষই বোঝে, কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় হরতাল আসবে। অথচ সরকার তা জানে না, তা হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। সেটা হাতে পাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান কেন সংশোধন করে ফেলা হলো, সেই বিস্ময় আমার যায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেওয়া হলে বিরোধী দলগুলো সেটা মানবে না, কাজেই তারা রাজপথে আন্দোলনে যাবে, সেটা যেকোনো বাচ্চা ছেলেও বোঝে। এই সংশোধনী তো সরকার তার ক্ষমতা-মেয়াদের একেবারে শেষ ভাগেও করতে পারত। তাড়াহুড়াটা কেন?
সরকারের নিশ্চয়ই অনেক সাফল্য আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতাও আসতে পারে। কিন্তু জেনেশুনে বিষপানের মতো ঘটনা একটার পর একটা কেন সরকার ঘটাচ্ছে, আমি অনেক চিন্তা করেও কোনো সমাধান পাই না। কতগুলো ইস্যু অপ্রয়োজনে তৈরি করে বিরোধী দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। যেসবের কোনো দরকারই ছিল না। ধরা যাক, বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধানে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এনে সমস্যার দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এটার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং তার কারণ নিয়ে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঢালাও অভিযোগ এনে তাঁদের গ্রেপ্তার করার পরিণতি কী হবে, সেটা কি সরকার বোঝে না? এই সিদ্ধান্তগুলো কে নিচ্ছেন? কীভাবে নিচ্ছেন?
সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপির আচরণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে। কারও পিএস টাকার থলি নিয়ে ধরা পড়েন, কারও বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে এবং সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। আচ্ছা, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না, কাজেই আমরা মালয়েশিয়া থেকে টাকা আনব, তাতে যদি সুদের হার বেশি দিতে হয়, সেই অতিরিক্ত টাকাটা কে দেবে? সরকারের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সেটা যদি কাল্পনিক আর বানোয়াটও হয়, তার দায় কেন জনগণ নেবে? সেই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করে সহজ শর্তে তহবিল সংগ্রহের দায়িত্ব সরকারের, পাবলিকের নয়।
কোনো এমপির গাড়িতে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়, কোনো এমপি জনতার উদ্দেশে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছেন, সেই ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সরকার ও প্রশাসনের চরম দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজে হতাশা প্রকাশ করেন। সর্বত্র দলীয়করণ, নিয়োগ-বাণিজ্য ও লুটপাট। এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ভূমিদস্যুতার। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর বিনিময়ে এমপি টাকা খান, লোক নিয়োগের নাম করে একই পদের বিপরীতে এলাকার একাধিক মানুষের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার অভিযোগ ওঠে এমপির বিরুদ্ধে। একদিকে দেশ চালাতে গিয়ে নানা সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতাগুলো যেমন প্রকট হয়ে উঠছে, তেমনি কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি বা পদস্থের আচার-আচরণ সরকার-সমর্থকদের মুখে চুনকালি মেখে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিরোধ মোকাবিলায় সরকারের আচরণ অসহিষ্ণু, নিপীড়নমূলক ও অগণতান্ত্রিক। বুঝতাম তা যদি কার্যকর হতো। মানে বলতে চাচ্ছি, দমন-নিপীড়ন করেও যদি সরকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারত, তবুও না হয় একটা সান্ত্বনা পাওয়া যেত। তা তো হচ্ছে না। নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এবং সরকারের একেকটা পদক্ষেপে তার জনপ্রিয়তায় একটা করে ধস নামছে।
যখন ব্যর্থতা আসে, তখন এমনি করেই আসে। একটার পর একটা ব্যর্থতার ঢেউ এসে আঘাত আনে। আর স্থানে স্থানে এমন সব কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে, মুখে চুনকালি পড়তে থাকে। তখন সরকারগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে, বাজে বকতে থাকে, দমনপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভাবতে থাকে, আমার মতো শক্তিশালী জগতে আর কেউ নেই। আমার মতো জনপ্রিয়ও পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কিন্তু পায়ের নিচের মাটি সরতে থাকে। তারপর যখন সরকারের পতন হয়, তখন সেটা হয় খুবই করুণ, খুবই শোচনীয়।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
এর মধ্যে রাজনীতিতে একটা সামান্য আশার আলো ফুটেছে। তা হলো, হরতালের বদলে বিরোধী দলের অনশন কর্মসূচিকে লোকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিও বলেছে, তারা হরতাল আহ্বান করতে চায় না। এই ছোট্ট আশাপ্রদ সূত্রটাকে ধরে উভয় পক্ষ কি এগিয়ে যেতে পারে না? সরকারের দিক থেকে সমঝোতার একটা চেষ্টা কি নেওয়া যায় না? রাজনৈতিক সমস্যার কোনো পুলিশি সমাধান নেই, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এটা না বোঝার মতো বোকা হতেই পারে না। সেখানেই আমাদের সামনে এক রহস্যময় ধাঁধা, রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি রাজনীতিকেরা নিচ্ছেন, নাকি অরাজনৈতিক কোনো উপদেষ্টা চক্রের হাতে পড়ে গেছে দেশ?
এই কলামের নাম ‘অরণ্যে রোদন’। কাজেই আমাকে অরণ্যে রোদন করে যেতেই হবে। রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে এগিয়ে আসুন। আরও দেড় বছর নির্বিঘ্নে দেশ চালনা করে সময়মতো নির্বাচন দিন। হরতাল আসতে পারে, এমন ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকুন।
আমি জানি, আমার এই কথা অরণ্যে রোদন মাত্র। একটা ভুল আরেকটা ভুল ডেকে আনে, একটা ভুল ঢাকার জন্য আরও ভুলের সিরিজ ডেকে আনা হয়।
আহা, এই দেশের সৃষ্টিশীল উদ্যমী মানুষগুলোর জন্য আমার কেবল মায়াই হয়, আফসোসই হয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কত বিরূপ, এর মধ্যেই কৃষকেরা বাম্পার ফসল ফলাচ্ছেন, শ্রমিকেরা-উদ্যোক্তারা-ব্যবসায়ীরা অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছেন, প্রবৃদ্ধি অর্জন করছেন। নিশাত মজুমদারেরা এভারেস্টে উঠে বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। আমাদের রাজনীতি যদি একটু মানুষবান্ধব হতো, আমরা কোথায় পৌঁছাতাম।
No comments:
Post a Comment