একটা সত্যি ঘটনা আপনাদের বলি।
১৯৯৭ সাল। ২ অক্টোবর থেকে ভোরের কাগজ-এ প্রতিবেদক জায়েদুল আহসানের একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে লাগল। বিষয়: ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর রহস্যময় সামরিক অভ্যুত্থান ও সৈনিকদের গণফাঁসি।
২০ বছর আগের ঘটনায় যাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের নামের তালিকা ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হলো।
এই সময় ভোরের কাগজ-এর বাংলামোটর দপ্তরে এলেন একজন মা আর তাঁর যুবক পুত্র।
এই নারীর স্বামী আজ থেকে ২০ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন। তিনি জানেন না, তাঁর স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে। তিনি কি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। মারা গেলে কবে, কোথায় কীভাবে মারা গেছেন।
এই যুবক জানেন না, তাঁর বাবা কোথায়? বাবার কোনো স্মৃতিও তাঁর মনে নেই।
তাঁরা শুনেছেন, ভোরের কাগজ-এ ফাঁসিপ্রাপ্ত সৈনিকদের নামের তালিকা ছাপা হয়েছে।
তাঁরা সেই কাগজটা দেখতে চান।
তাঁরা জানতে চান, তাঁদের স্বামী/বাবার নাম এই তালিকায় আছে কি না।
তাঁরা ভোরের কাগজ অফিসের দোতলায় বসলেন।
তাঁদের সামনে ভোরের কাগজ-এর উদ্দিষ্ট সংখ্যাটা মেলে ধরা হলো। তাঁরা দীর্ঘ তালিকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন।
তাঁদের বাবা/স্বামীর নাম পাওয়া গেল। তাঁরা জানলেন, ২০ বছর আগে তাঁদের প্রিয় মানুষটির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।
ছেলেটি বললেন, সামনেই বাবার মৃত্যুদিবস। এই বার আমরা তাঁর মৃত্যুর দিনটা পালন করতে পারব।
মা আর ছেলে ভোরের কাগজ অফিস থেকে ধীর পায়ে নেমে গেলেন।
২.
আসুন, আমরা আরেকটা কাহিনি নির্মাণ করি। একজন ২০ বছর বয়সের তরুণী। তাঁর নাম, ধরা যাক, নিলুফার বানু। তাঁর একটা ছেলে। নাম খোকা। খোকা কেবল হাঁটতে শিখেছে। দাদা, মামা, মাম—এ ধরনের কয়েকটা শব্দও খোকা বলতে পারে।
নিলুফারদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ আছে। ব্যাংকে তাঁর স্বামীর জমানো টাকা আছে ১০-১৫ লাখ। স্বামী একটা ফ্ল্যাট কিনবেন বলে টাকা জমাচ্ছেন।
একদিন তাঁর স্বামী প্রতিদিনের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরে এলেন না।
নিলুফার কান্নাকাটি করলেন। মূর্ছা গেলেন কয়েকবার। থানা থেকে থানায় দৌড়ালেন। লাশ পাওয়া গেছে খবর পেলেই ছুটে গেলেন মর্গে। হাসপাতালে হাসপাতালে খবর নিলেন। পত্রিকায় নিখোঁজ স্বামীর ছবি ছাপা হলো।
কিন্তু স্বামী ফিরে এলেন না।
ছেলে বড় হচ্ছে। তাঁদের সংসারও তো চালাতে হবে। নিলুফার ব্যাংকে গেলেন। বললেন, ব্যাংকের টাকাটা তুলতে হবে। আমাকে তিনি নমিনি করে গেছেন। আমি জানি। টাকাটা আমি তুলব।
ব্যাংকের ম্যানেজার তাঁকে দেখামাত্রই চিনলেন। বললেন, আপনার ঘটনা আমরা জানি। আমাদের সমবেদনা রইল। কিন্তু আপনার স্বামী যেহেতু মারা যাননি, কাজেই আপনি এই টাকা তুলতে পারবেন না। তিনি তো যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারেন।
গ্রামে স্বামীর নামে দুই বিঘা জমি ছিল। নিলুফার ভাবলেন, জমিটা বিক্রি করে দেবেন।
কিন্তু তিনি তাও পারবেন না। কারণ, তাঁর স্বামী মারা যাননি। আইনত, তাঁকে এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে তাঁর স্বামীর ফিরে না আসার জন্য।
নিলুফারের বাবা-মা ভাবলেন, মেয়েকে আরেকবার বিয়ে দেওয়া দরকার।
কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। কারণ, নিলুফারের স্বামী মারা যাননি। নিখোঁজ হয়েছেন। বিয়ের পরের দিনই যদি খোকার বাবা ফিরে আসেন, তখন কী কাণ্ডটাই না ঘটবে।
৩.
প্রথম আলোর প্রথম পাতাতেই খবরটা ছাপা হয়েছিল। গুম বিষয়ে। একজন নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজন বিলাপ করে বলেছিলেন, এর চেয়ে ‘ক্রসফায়ার’ তো ভালো ছিল। নিশ্চিত হওয়া যেত যে মারা গেছে। কোথায়, কবে মারা গেছে তা-ও জানা যেত। লাশটাও পাওয়া যেত। কিন্তু এ যে ঘোরতর অনিশ্চয়তা!
৪.
কেন লিখি। কেন এই রকম লিখি। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিই।
বলি:
‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে
শিশিরের মতো রবে।’
উদ্ধৃতি দেওয়াই সার। একটা কাঁটাও দূর করতে পারি না। একটা শিশুর মুখেও স্নেহের শিশির জোগাতে পারি না। স্নেহসুধায় আরেকটু আপনার করে তুলতে পারি না কোনো বাসগৃহতল।
কী যে খারাপ লাগে!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
১৯৯৭ সাল। ২ অক্টোবর থেকে ভোরের কাগজ-এ প্রতিবেদক জায়েদুল আহসানের একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে লাগল। বিষয়: ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর রহস্যময় সামরিক অভ্যুত্থান ও সৈনিকদের গণফাঁসি।
২০ বছর আগের ঘটনায় যাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের নামের তালিকা ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হলো।
এই সময় ভোরের কাগজ-এর বাংলামোটর দপ্তরে এলেন একজন মা আর তাঁর যুবক পুত্র।
এই নারীর স্বামী আজ থেকে ২০ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন। তিনি জানেন না, তাঁর স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে। তিনি কি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। মারা গেলে কবে, কোথায় কীভাবে মারা গেছেন।
এই যুবক জানেন না, তাঁর বাবা কোথায়? বাবার কোনো স্মৃতিও তাঁর মনে নেই।
তাঁরা শুনেছেন, ভোরের কাগজ-এ ফাঁসিপ্রাপ্ত সৈনিকদের নামের তালিকা ছাপা হয়েছে।
তাঁরা সেই কাগজটা দেখতে চান।
তাঁরা জানতে চান, তাঁদের স্বামী/বাবার নাম এই তালিকায় আছে কি না।
তাঁরা ভোরের কাগজ অফিসের দোতলায় বসলেন।
তাঁদের সামনে ভোরের কাগজ-এর উদ্দিষ্ট সংখ্যাটা মেলে ধরা হলো। তাঁরা দীর্ঘ তালিকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন।
তাঁদের বাবা/স্বামীর নাম পাওয়া গেল। তাঁরা জানলেন, ২০ বছর আগে তাঁদের প্রিয় মানুষটির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।
ছেলেটি বললেন, সামনেই বাবার মৃত্যুদিবস। এই বার আমরা তাঁর মৃত্যুর দিনটা পালন করতে পারব।
মা আর ছেলে ভোরের কাগজ অফিস থেকে ধীর পায়ে নেমে গেলেন।
২.
আসুন, আমরা আরেকটা কাহিনি নির্মাণ করি। একজন ২০ বছর বয়সের তরুণী। তাঁর নাম, ধরা যাক, নিলুফার বানু। তাঁর একটা ছেলে। নাম খোকা। খোকা কেবল হাঁটতে শিখেছে। দাদা, মামা, মাম—এ ধরনের কয়েকটা শব্দও খোকা বলতে পারে।
নিলুফারদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ আছে। ব্যাংকে তাঁর স্বামীর জমানো টাকা আছে ১০-১৫ লাখ। স্বামী একটা ফ্ল্যাট কিনবেন বলে টাকা জমাচ্ছেন।
একদিন তাঁর স্বামী প্রতিদিনের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরে এলেন না।
নিলুফার কান্নাকাটি করলেন। মূর্ছা গেলেন কয়েকবার। থানা থেকে থানায় দৌড়ালেন। লাশ পাওয়া গেছে খবর পেলেই ছুটে গেলেন মর্গে। হাসপাতালে হাসপাতালে খবর নিলেন। পত্রিকায় নিখোঁজ স্বামীর ছবি ছাপা হলো।
কিন্তু স্বামী ফিরে এলেন না।
ছেলে বড় হচ্ছে। তাঁদের সংসারও তো চালাতে হবে। নিলুফার ব্যাংকে গেলেন। বললেন, ব্যাংকের টাকাটা তুলতে হবে। আমাকে তিনি নমিনি করে গেছেন। আমি জানি। টাকাটা আমি তুলব।
ব্যাংকের ম্যানেজার তাঁকে দেখামাত্রই চিনলেন। বললেন, আপনার ঘটনা আমরা জানি। আমাদের সমবেদনা রইল। কিন্তু আপনার স্বামী যেহেতু মারা যাননি, কাজেই আপনি এই টাকা তুলতে পারবেন না। তিনি তো যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারেন।
গ্রামে স্বামীর নামে দুই বিঘা জমি ছিল। নিলুফার ভাবলেন, জমিটা বিক্রি করে দেবেন।
কিন্তু তিনি তাও পারবেন না। কারণ, তাঁর স্বামী মারা যাননি। আইনত, তাঁকে এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে তাঁর স্বামীর ফিরে না আসার জন্য।
নিলুফারের বাবা-মা ভাবলেন, মেয়েকে আরেকবার বিয়ে দেওয়া দরকার।
কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। কারণ, নিলুফারের স্বামী মারা যাননি। নিখোঁজ হয়েছেন। বিয়ের পরের দিনই যদি খোকার বাবা ফিরে আসেন, তখন কী কাণ্ডটাই না ঘটবে।
৩.
প্রথম আলোর প্রথম পাতাতেই খবরটা ছাপা হয়েছিল। গুম বিষয়ে। একজন নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজন বিলাপ করে বলেছিলেন, এর চেয়ে ‘ক্রসফায়ার’ তো ভালো ছিল। নিশ্চিত হওয়া যেত যে মারা গেছে। কোথায়, কবে মারা গেছে তা-ও জানা যেত। লাশটাও পাওয়া যেত। কিন্তু এ যে ঘোরতর অনিশ্চয়তা!
৪.
কেন লিখি। কেন এই রকম লিখি। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিই।
বলি:
‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে
শিশিরের মতো রবে।’
উদ্ধৃতি দেওয়াই সার। একটা কাঁটাও দূর করতে পারি না। একটা শিশুর মুখেও স্নেহের শিশির জোগাতে পারি না। স্নেহসুধায় আরেকটু আপনার করে তুলতে পারি না কোনো বাসগৃহতল।
কী যে খারাপ লাগে!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments:
Post a Comment