Monday, May 7, 2012

ঘা মারো, বাঁচাও


আজ পঁচিশে বৈশাখ। আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশে ও ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপিত হয়েছে, যৌথভাবেও। ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আছেন, যিনি বারবার করে বলেছেন, ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ’। প্রতিবেশীর সঙ্গে, এমনকি অপ্রতিবেশীর সঙ্গেও বন্ধুত্বই লাভজনক। 
ভারত আর বাংলাদেশের বন্ধুত্বের মধ্যে এখন কাঁটাতারের বেড়া হয়ে আছে অপরিচয়ের দূরত্ব। এ দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বন্ধুত্বের, সুসম্পর্কের যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা মরুপথে হারিয়ে যায়। তার একটা কারণ, অপরিচয়ের সংকট। মানুষে মানুষে যদি যোগাযোগ বাড়ে, আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়, তাহলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব পোক্ত হবে, কার্যকর হবে।
আমরা ভারতকে যত জানি, ভারত আমাদের তত জানে না। আমরা ভারতের ছবি দেখি, টেলিভিশন চ্যানেল দেখি, গান শুনি, কলকাতার লেখকদের লেখা আমাদের মুখস্থ, এমনকি ভারতের ইংরেজি ভাষার লেখকেরা কে কোথায় কী করছেন, আমাদের অজানা নয়। ভারতের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। 
এ প্রসঙ্গ উঠেছিল গত ১৭ এপ্রিল প্রথম আলো আর ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে মৈত্রীবন্ধন শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আসাদুজ্জামান নূর যখন কলকাতা টাউন হলে আবৃত্তি করতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, তাঁর দলবলসমেত, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা মিলিয়ে একটা কাব্যালেখ্যর নাটকীয় উপস্থাপনা নিয়ে। আবৃত্তির পরে আলোচনা। আসাদুজ্জামান নূরই প্রসঙ্গটা পাড়লেন। মুম্বাই থেকে কজন তরুণ এসেছিলেন বাংলাদেশে, ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠান নির্মাণের কাজে সহায়তা করতে। তাঁদের নূর নিমন্ত্রণ করেছিলেন তাঁর বাসভবনে। ওই তরুণদের একজন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যে এমন, তা আমাদের ধারণাই ছিল না।’ নূর তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আপনারা কেমন ভেবেছিলেন?’ ওই তরুণ বলেছিলেন, কোনো মিডল ইস্টার্ন কান্ট্রির মতো। আসাদুজ্জামান নূর কলকাতার টাউন হল মঞ্চে তাই বললেন, কলকাতার চেয়ে ভারতের অন্য রাজ্যে এ ধরনের অনুষ্ঠান বেশি বেশি করা দরকার।
একজন দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে আসাদুজ্জামান নূরের এ বক্তব্য সমর্থন করে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগলেন, সাধারণ ভারতীয়রা বাংলাদেশ সম্পর্কে কত কম জানে, বা কত ভুল জানে। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অবশ্য সেই দর্শককে বললেন, আপনার অভিজ্ঞতাই শেষ কথা নয়, এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই আগ্রহ পোষণ করেন, যাঁরা বাংলাদেশের সাহিত্য-শিল্প-নাটকের খোঁজখবর রাখেন। যেমন রুদ্র নিজেই তা করে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ যদিও বলেছিলেন, ‘অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে? অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে’। তবু মনে হয়, বাংলাদেশকে কম জানা, বা না জানা দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভারতের শীর্ষ পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের বহু পর্যায়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নত করার জন্য সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা যায়, ভারতের আমলাতন্ত্রে উদ্যোগগুলো আটকে যায়। চুক্তি হয়, প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু কার্যকর হয় না। ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষিত হয়, টাকাটা আসে না। 
১৬ এপ্রিল কলকাতার টাউন হল মঞ্চে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা ও পাঠের আয়োজনে ছিলেন ভারতের নমিতা গোখলে আর বাংলাদেশের সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আমিও ছিলাম। আমি বললাম, এক দিন আগে পয়লা বৈশাখ সারা বাংলাদেশে কী বিপুলভাবে, কী মহাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়েছে, আপনারা যদি জানতেন! লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়। ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে, প্রতিটা পার্কে, রমনায়, ধানমন্ডি লেকের ধারে, চন্দ্রিমা উদ্যানে, মিলনায়তনে, সারা বাংলাদেশের প্রতিটা শহরে কত যে মঞ্চ, কত যে অনুষ্ঠান, আর কোনোটাতেই লোকের কোনো অভাব নেই। আপনারা কলকাতায় বসে এটা কল্পনাও করতে পারবেন না। 
আমাদের পয়লা বৈশাখ আমরা সংগ্রাম করে অর্জন করেছি। 
যেমন আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অর্জন করে নিয়েছি সংগ্রাম করে। ষাটের দশকে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকী পালনে বাধা এল, তখন আমরা সেই বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের করে নিয়েছি, সে জন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসা, অশ্রু, স্বেদ আর রক্তের মাধ্যমে অর্জিত রবীন্দ্রনাথ। এর তাৎপর্য ভারতবাসী বুঝবে কি না, আমি জানি না।
কিন্তু আমাদের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের মধ্যে দূরত্ব দূর করুক। দুই দেশের বন্ধুত্বকে দুই দেশের মানুষের জন্য উপকারের ক্ষেত্র দিক। রবীন্দ্রনাথ মিলনের কথা বলেছেন, এমনকি মুক্তধারা নাটকে সরাসরি এবং রূপকার্থে বলেছেন নদীতে বাঁধ দেওয়ার ক্ষতির কথা, বলেছেন বাঁধ ভেঙে দেওয়ার কথা, সে কথাও আমরা স্মরণ করব—
‘বিভূতি: ... আমার বাঁধ সম্পূর্ণ হয়েছে।
দূত: শিবতরাইয়ের প্রজারা এখনও জানে না। তারা বিশ্বাসই করতে পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন, কোনো মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।’
প্রকৃতির গতিকে রুদ্ধ করার পরিণতি ভালো হয় না। 
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফর করলেন। উপলক্ষ এই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ সেই দেওয়া-নেওয়া উভয়ের ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে, সমমর্যাদার ভিত্তিতে হোক।
একই সময়ে এসেছিলেন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। 
এটিএন বাংলার সাংবাদিক জ ই মামুন হিলারিকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ চায়—এ রকম অনেক দাবি আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে কী চায়? হিলারি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ দুই গণতান্ত্রিক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে অন্য কিছু চায় না। যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায়, একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভালো করছে, এগিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি।
তিনি আমাদের অতিথি। অতিথির কথার পিঠে আমরা কথা বলি না। আমাদের সংস্কৃতি হলো, অতিথিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো। 
শুধু মনে পড়ে, পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার আগেই, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রু ম্যানের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, ‘১৫ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তান রাষ্ট্র বলে একটা নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমের একটা বড় অংশ আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটা ছোট অংশ নিয়ে। ৭৫ মিলিয়ন লোকের পাকিস্তান হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র, আর এটা হবে রণকৌশলের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।’
পাকিস্তানের জন্মের আগেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁরা বন্ধুত্ব করবেন। কারণ, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশল-সংক্রান্ত এলাকা।
সেই বন্ধুত্বের পরিণাম কী হয়েছে, আমরা জানি। এখনো পাকিস্তানকে ভুগতে হচ্ছে।
আমেরিকা সারা পৃথিবীতে যেখানেই গেছে, নিজের স্বার্থেই গেছে। তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদের একটা মানে আছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের সংজ্ঞা তারা নিজেদের দেশে নিজেদের নাগরিকদের জন্য যে মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করে, সেই একই মাপকাঠিতে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতেও পরিমাপ করে, এ রকম ভাবার কোনো বাস্তব কারণ আছে কি?
শঙ্খ ঘোষ তাঁর বটপাকুড়ের ফেনা বইয়ে একটা নিবন্ধ লিখেছেন, ‘অন্যের ভালো করা।’ ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার ৫০০ জন প্রকাশক ও পাঠাগার পেশাজীবী প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে এক চিঠি লেখেন। বলেন, ‘আসুন, আমরা আমাদের তরুণদের পৃথিবীর আরেক প্রান্তে নিহত হওয়ার জন্য পাঠানো বন্ধ করি। আসুন, আমরা ভিয়েতনামের মানুষ আর অর্থনীতি ধ্বংস করা বন্ধ করি।’
তখন জন আপডাইক নামের একজন ঔপন্যাসিক বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম ফর আওয়ার ইনভেনশন ইফ ইট ডাজ সাম গুড।’ যদি এতে ভালো হয়, তাহলে আমি সৈন্য প্রেরণ বা হস্তক্ষেপের পক্ষে।
শঙ্খ ঘোষ বলছেন, ‘অন্যের ভালো করার এই মহান দায়িত্ব পরের ৪০ বছর পরে জুড়েও সমানভাবেই চলছে।’
যা-ই হোক, আমেরিকার সঙ্গেও আমাদের বন্ধুত্ব আমাদের স্বার্থেই দরকার। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের রয়েছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা, আর তা হলো আমরা আমেরিকায় রপ্তানি করি, আমেরিকা থেকে আমদানি করি খুব কম। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান খাত তৈরি পোশাকের বড় বাজার আমেরিকা। অন্য কোনো কারণে না হোক, শুধু এ কারণে আমাদের উচিত এমন কিছু না করা, যাতে আমেরিকা ক্ষুব্ধ হয়। এটা আমেরিকার স্বার্থে নয়, আমাদের স্বার্থেই প্রয়োজন।
আমার দুঃখ কী জানেন! আমরা কতগুলো সমস্যা নিজেরা অকারণে তৈরি করলাম। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সারা পৃথিবীতে সম্মানিত মানুষ, তাঁকে আমরা বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম। তা না করে তাঁকে হেনস্তা করা হলো অকারণে। আজ কানাডা বা বিশ্বব্যাংক আমাদের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। আমাদের মানবাধিকার-পরিস্থিতি নিয়ে অতিথিরা কথা বলছেন, এ পরিস্থিতি আমরা নিজেরা তৈরি করেছি। এ সুযোগ আমরা তাঁদের করে দিয়েছি। 
আল্লাহ তা’আলা তো সে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে না, যে জাতি নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন করে না।
আমাদের রাজনীতি ও বাস্তবতা দেখে মনে হয়, আমরা চাই না দেশে শান্তি থাকুক, আমরা চাই না দেশে স্থিতিশীলতা থাকুক। সেখানে অন্যরা এলেন, বললেন, চলে গেলেন, জয় করলেন কি করলেন না, তাতে কী এসে যায়!
হিলারি ক্লিনটন অনেকটা সময় দিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে। বলেছেন, ওইখানেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। সেটা তাঁরা না বললেও আমরা জানি। বাংলাদেশের সমস্ত সম্ভাবনার মূলে তার কোটি কোটি তরুণ। যারা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা এগিয়ে আসছে। যাদের বেশির ভাগই পড়ে বাংলা মাধ্যমে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে যারা এগিয়ে আসছে, যারা হাজারে হাজারে জিপিএ ফাইভ পায়। যাদের কাছে পয়লা বৈশাখের তাৎপর্য খুবই নিত্তনৈমিত্তিক, যাদের কাছে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই রেখেছেন,
‘বাহির পানে তাকায় না যে কেউ
দেখে না যে বান ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।
চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে
মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলে,
আছে অচল আসনখানা মেলে।
যে যার উচ্চ আপন বাঁশের মাচায়,
আয় অশান্ত আয় রে আমার কাঁচা।’
তাই তো তরুণদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের ডাক,
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ ওরে অবুঝ
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
আমরা প্রবীণেরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমরা বাঁচব না, সবাই মিলে আত্মহত্যা করব, তখন ওই সবুজ তরুণেরাই যদি আমাদের বাঁচায়।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।


1 comment:

  1. Earn 1000 dollar per month without investment by internet? Don't believe ? Please ,Stay with Us.We help you,but you have to work.Suggest for them who has no works.Please stay with us.
    Earning Money Online,
    Earn Money Online in India
    Clixsense in India

    ReplyDelete