Monday, May 28, 2012

পুলিশ কেন মারে?


সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না?
সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না?
আমাদের তিন সহকর্মী রাজধানীর ট্রমা সেন্টারের বিছানায় শুয়ে আছেন। আমাদের একজন নিয়মিত প্রদায়ক কিলঘুষি খেয়ে প্রথম আলো অফিসে বসে ছিলেন, তাঁর শরীরজোড়া মারের দাগ, চোখ-মুখ ফোলা। পুরো ঘটনায় আমার কতগুলো অনুভূতি হচ্ছে। এক. নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে। দুই. খুব অপমানিত বোধ করছি। তিন. নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়েছে। চার. আমাদের দেশটা নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে উদ্বেগ সীমাহীনভাবে বেড়ে গেছে। সবটা মিলিয়ে যা তৈরি হয় তা ক্রোধ, ক্ষোভ, হতাশা।
প্রথম আলোর ফটোসাংবাদিক খালেদ সরকার আর প্রদায়ক হাসান ইমামের ওই সময় (শনিবার, ২৬ মে, ২০১২, সকালবেলা) আগারগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার কথা নয়। আমার বন্ধু নদী-বিশেষজ্ঞ ড. মনসুর রহমান ফোন করে আমাকে জানালেন, আগারগাঁওয়ে এক মিলনায়তনে তাঁরা একটা আন্তর্জাতিক সেমিনার করছেন। দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞরা একটা জনবহুল বদ্বীপের মানুষ কীভাবে বেঁচে থাকবে, কীভাবে দারিদ্র্যমুক্ত থাকতে পারবে, তাই নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা তুলে ধরবেন। আমি সেই খবর ও ছবি সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করেছিলাম সংশ্লিষ্টদের। সেই খবর সংগ্রহ করতেই আলোকচিত্রী খালেদ সরকার আর প্রদায়ক হাসান ইমাম আগারগাঁওয়ে গিয়েছিলেন। খবর ও ছবি সংগ্রহ করে তাঁরা ফিরছিলেন।
ওই সময় তাঁরা দেখেন, রাস্তায় পলিটেকনিকের ছাত্রীরা বিক্ষোভ করছেন। 
খালেদ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা থেকে মাস্টার্স পাস করে প্রথম আলোয় আলোকচিত্র সাংবাদিকতা করেন। অত্যন্ত বিনয়ী, সদাহাসিমুখ, কর্তব্যপরায়ণ। রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটছে, খালেদ ছবি তুলতে আরম্ভ করেন। অন্যদিকে এই ঘটনার ছবি তুলতেই আসেন প্রথম আলোর সাংবাদিক জাহিদুল করিম ও সাজিদ হোসেন।
তখন বিক্ষোভ প্রায় প্রশমিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছাত্রীরা তখনো রাস্তায় রয়ে গেছে। হঠাৎ কোনো ঘটনা ঘটলে ‘এক্সক্লুসিভ’ ছবি পাবেন, এই আশায় এক ফটোসাংবাদিক ফাঁকা রাস্তায় একটা পুলিশের গাড়ির পেছনে মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে থাকেন।
এই সময়েই পুলিশের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। পুলিশ বলে, আপনারা এই রাস্তায় মোটরসাইকেল নিয়ে আসছেন কেন? সাংবাদিক বলেন, ছবি তুলতে। একপর্যায়ে বলেন, যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, আপনি মামলা করেন। গালিগালাজ করছেন কেন?
যাঁদের হাতে লাঠি আছে, অস্ত্র আছে, তাঁরা গালিগালাজ করবেন, তাঁদের কি জিজ্ঞেস করতে আছে, গালি দিচ্ছেন কেন? 
পুলিশের কর্তা নির্দেশ দেন পেটাও। সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না।
তারপর শুরু হয় বৃষ্টির মতো মার। কলার ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মার। রাস্তায় ফেলে মার। লাঠি দিয়ে বেধড়ক মার। কান বরাবর ঘুষি। রাইফেলের বাঁট দিয়ে মার। একজনকে মারতে দেখে আরেকজন সাংবাদিক ছুটে আসেন। তিনজন ফটোসাংবাদিকই প্রচণ্ড প্রহার-বৃষ্টির মধ্যে পড়েন। 
গত পরশু ট্রমা সেন্টারে গিয়ে মারের চোটে থেঁতলানো দেহ নিয়ে পড়ে থাকা তিন সাংবাদিককে দেখতে যাই। একজন বলেন, কোত্থেকে সাদা পোশাকের পুলিশ এসে যে চড়াও হয় এবং প্রচণ্ড মার মারতে থাকে, আল্লাহই জানেন।
মারের চোটে একজনের ঠোঁট কেটে গেছে, দড়দড়িয়ে রক্ত পড়ছে। শরীর জোড়া তাঁদের মারের দাগ। ভেতরে মাংস থেঁতলে গেছে। সাজিদের কানের পেছনে এমন ঘুষি মেরেছে, ফুলে কালো হয়ে আছে জায়গাটা। আমাদের নিরীহ প্রদায়ক মোবাইল ফোনে এই মারধরের ছবি তুলছিলেন, এবার পুলিশ চড়াও হয় তাঁর ওপর। তাঁকে বেধড়ক কিলঘুষি মেরে তাঁর মোবাইল কেড়ে নেয়।
ওই পুলিশ সদস্যদের বড় আক্রোশ ছিল ক্যামেরার ওপর। তারা ক্যামেরা ছিনিয়ে নিতে চায়। ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি হয়। শেষ পর্যন্ত ক্যামেরা তারা কেড়ে নিয়েই ছাড়ে। এই সাংবাদিকদের থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে সারা পথে কিলঘুষি-চড় মারা হয়।
এসি শহীদুলের উক্তিটা তাৎপর্যপূর্ণ। ‘এই রকম কত সাংবাদিক দেখছি, কত মারছি। এগুলান রে মারলে কিছু হয় না।’
এখানেই আসে আমার দ্বিতীয় অনুভূতিটার কথা। অপমানবোধ। পুলিশ কিন্তু সাংবাদিকদের মার শুরু করেছে কিলঘুষি-চড় দিয়ে, কলার ধরে টানাটানি দিয়ে। একজন সাংবাদিক হিসেবে এই চড় আমার নিজের গালে এসে লাগছে। আর ওই কথাটা? সাংবাদিক পেটালে কিছু হয় না। সত্যি তো, কিছু হয় না। আমার ছোট ভাই সাগর সরওয়ার, আমার ছোট বোন মেহেরুন রুনি নিজ বাড়িতে নৃশংসভাবে খুন হলো, তাদের দেবদূতের মতো ছেলেটা, মেঘ, বাবা-হত্যার বিচার দাবিতে রাস্তায় পর্যন্ত নামল, কী হয়েছে? কিছু হয় না তো আসলে।
ট্রমা সেন্টারে যখন আমি আহত ক্ষত-বিক্ষত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলি, ওঁরা বলেন, কোথাও কোনো বড় গণ্ডগোল হলে সাংবাদিকেরা মারের মধ্যে পড়ে যান, আহত হন, আমরা তো সেটা আমাদের কাজের অংশই ধরে নিয়েছি। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া, কোনো উত্তেজনা ছাড়া শুধু সাংবাদিক পেটানোর জন্যই একযোগে নিরস্ত্র কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া আর নির্মমভাবে মারা, যেন একটা স্যাডিজমের লক্ষণ; অন্যকে পীড়িত-অত্যাচারিত হতে দেখে আনন্দিত হওয়া।
এ থেকে একটা সার্বিক নিরাপত্তাহীনতার বোধ তৈরি হয়। সাগর-রুনি মারা যাচ্ছেন নিজের বাড়িতে, বিদেশি কূটনীতিক মারা যাচ্ছেন রাস্তায়, রাজনৈতিক নেতা বা গার্মেন্টস শ্রমিক নেতা হারিয়ে যাচ্ছেন রাজপথ থেকে, পুলিশ রাজনৈতিক নেতাদের পেটাচ্ছে, শিক্ষকদের পেটাচ্ছে, সাংবাদিকদের পেটাচ্ছে, সংসদ সদস্যকে পেটাচ্ছে। এর আগে পুলিশ কমনওয়েলথে স্বর্ণপদক পাওয়া আসিফকে পিটিয়েছিল।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে কূলকিনারা না হওয়া থেকে শুরু করে গাড়িতে তিন কর্তব্যরত সাংবাদিককে তুলে সারাটা পথ পেটাতে পেটাতে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা একত্র করলে একটা তীব্র হতাশার বোধ তৈরি হয় না কি? তার মানে এটা একটা নৈরাজ্যের লক্ষণ। 
পুলিশের হাতে লাঠি আছে। পুলিশের হাতে অস্ত্র আছে। সেই কারণেই তাদের শৃঙ্খলার পরিচয় দিতে হবে, সেই কারণেই তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আপনি গাড়িতে তুলে সাংবাদিককে মারলেন কোন আইনের বলে?
যদি কেউ রং সাইডে মোটরসাইকেল চালিয়ে থাকে, তাহলে তাকে আপনি মারবেন কেন? তার ক্যামেরা কেড়ে নেবেন কেন? কোন আইনের ধারায় আপনি মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নিচ্ছেন। মেমরি কার্ড খুলে নিলেন কোন আইনে?

২.
অথচ পুলিশের কাছে আমরা যাই ভরসার সন্ধানে। একটা ঘটনা বলি। ১৯৯০ সালের এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আমি একজন তরুণ সাংবাদিক, সাপ্তাহিক পূর্বাভাস নামের একটা কাগজ আমরা বের করি। যেদিন পত্রিকা ছাপা হবে, কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে যায়। স্টেডিয়ামের পত্রিকা অফিস থেকে বের হয়ে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হাঁটছি, এরই মধ্যে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। কোনো যানবাহন নেই রাস্তায়। আমাকে যেতে হবে বকশীবাজার। একটা পুলিশের গাড়ি এসে আমার পাশে থামে। আমাকে বলে, কারফিউ শুরু হয়ে যাচ্ছে, আপনি কই যান? আমি বলি, আমি সাংবাদিক, কাজ শেষ করে ঘরে ফিরছি। ওরা বলেন, রাস্তায় মিলিটারি নেমেছে, আমরা না হয় আপনাকে ছেড়ে দিলাম, মিলিটারির সামনে পড়লে যদি আপনার কিছু হয়। আমি বলি, আমি তো কোনো যানবাহন পাচ্ছি না। একটা কাজ করেন, আমাকে আপনাদের গাড়িতে তুলে একটু বকশীবাজারে নামিয়ে দেন।
ওরা আমাকে গাড়ি করে বকশীবাজারের মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিলেন। আমি জানি, পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ধারণা, যাকে বলে, পারসেপশন, সেটা নেতিবাচক। কারা দুর্নীতি বেশি করে, অর্থমন্ত্রী সেই দিনও যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে পুলিশের নাম আছে।
কিন্তু আমি সাধারণভাবে, অতিসরলীকৃতভাবে কথা বলতে চাই না। ভালো মানুষ সব পেশাতেই আছেন। খারাপ মানুষও সব পেশাতেই আছেন। সাংবাদিকদের মধ্যেও ভালো-খারাপ আছে।
পুলিশের বর্তমান আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকারকে অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি মৃদভাষী অমায়িক একজন মানুষ বলে আমার মনে হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজির আহমেদের একটা বক্তৃতা শুনে আমি কী যে মুগ্ধ হয়েছি। নিখোঁজ মানুষদের সন্ধানে একটা আশ্রয়কেন্দ্র হবে, সেই উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠানে তিনি বক্তৃতা করলেন। তিনি এই উপমহাদেশে কত কারণে মানুষ হারিয়ে যায়, তার সামাজিক কারণ, ঐতিহাসিক কারণ, আমাদের প্রাচীন সাহিত্যে কোথায় কবে হারিয়ে যাওয়ার কী প্রসঙ্গ আছে, এমন সুন্দর করে বললেন যে আমি একেবারে থ বনে গেলাম। আমার লেখা ছাপা হলে যাঁরা সেটার ভালোমন্দ আলোচনা করতে ফোন করেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই পুলিশ অফিসার। সেদিনও পুলিশের একজন ডিআইজির সঙ্গে দেখা হলো, তিনি গোয়েন্দা শাখায় আছেন, প্রথম কথাই হলো, আনিস ভাই, আমরা কিন্তু আপনার ‘মা’ বইয়ের ভক্ত। আমি এটা জানি, মা বইটা পুলিশের অনেক কর্তা নিজেরা পড়েন, আর অন্যদের কিনে কিনে উপহার দেন। এই নিয়ে তাঁদের সঙ্গে আমার অনেকবার কথা হয়েছে। কমিউনিটি পুলিশ নামে একটা আন্দোলন পুলিশ করার চেষ্টা করছে, আমি তাদের অনুষ্ঠানে মিরপুরে ও উত্তরায় বক্তৃতা দিতে গেছি।
আর আমি ভুলতে পারি না যে একাত্তর সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকে কী নৃশংস হামলাই না করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। পুলিশও সেদিন বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, প্রতিরোধ করতে গিয়ে শহীদ হয়েছিলেন অনেকেই। সেই সব শহীদের নাম রাজারবাগের স্মৃতিফলকে উৎকীর্ণ আছে।
আমি যখন কোনো মোড়ে যানজটে আটকা পড়ি, আমি পুলিশ কনস্টেবলদের দেখি, কী রোদে কী বৃষ্টিতে এই বিশৃঙ্খল যানগুলোকে ‘লাইনে’ আনতে কী প্রাণান্তকর পরিশ্রমই তাঁরা করছেন। দূষণকারী ধোঁয়ার মধ্যে নিজেকে ক্ষয়ে দিতে দিতে যানবাহনের গতিটাকে সচল রাখতে কী মরিয়া চেষ্টাই না করে চলেছেন বেচারা।
কাজেই পুলিশকে যখন ঢালাওভাবে গালিগালাজ করা হয়, আমি সেটাকে সমর্থন করতে পারি না। 
কিন্তু এর সঙ্গে যখন সহকারী কমিশনার শহীদুল ইসলামের উক্তি মেলাই, সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না, তখন সত্যি ভীষণ অপমানিত বোধ করি।
এই মানসিকতা, এই মনোভাবের উৎস কী?
আইনের বাইরে গিয়ে, এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে পুলিশি পদক্ষেপকে যখন রাষ্ট্র উৎসাহিত করছে, এর একটা প্রভাব এই ধরনের মানসিকতার একটা কারণ হতে পারে।
রাজনৈতিক স্বার্থে পুলিশের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। 
আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আছে, অবশেষে পুলিশও গাইল রবীন্দ্রসংগীত।
সত্যি সত্যি পুলিশকে সুসংস্কৃত, সুশিক্ষিত হতে হবে। আমি আমার চেয়ে অনেক গুণ বেশি লেখাপড়া করা, সংস্কৃতিচর্চা করা পুলিশের দেখা পেয়েছি। তাঁদের এই সংস্কৃতিবোধটা পুরো পুলিশ বাহিনীতেই ছড়িয়ে দিতে হবে। সে জন্য যেমন তাঁদের প্রশিক্ষণের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করে তুলতে হবে যে প্রতিটা মানুষ সমান, প্রতিটা মানুষের জীবন মূল্যবান, প্রতিটা মানুষের সম্মানই সম্মান, পুলিশের কাজ মানুষকে রক্ষা করা, তাকে আহত করা, অসম্মান করা নয়; তেমনি এর অন্যথা হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নিতে হবে। যাতে কতিপয়ের জন্য সমগ্রের সম্মানহানি না ঘটে।
এই একটা ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা পুলিশ প্রশাসন গ্রহণ করে, তা শেষ পর্যন্ত মনিটর করার জন্য আমি সাংবাদিকদের অনুরোধ করব।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Monday, May 21, 2012

যে দেশে হরতাল নামের এক জিনিস আছে


হরতাল পলিসি ফর বাংলাদেশ। ব্রিটিশ কাউন্সিল সারা পৃথিবীতেই ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নিচ্ছে একই সময়ে—সাধারণত যা ‘ও-লেভেল’ আর ‘এ-লেভেল’ পরীক্ষা বলে পরিচিত। সারা পৃথিবীর সব দেশের জন্যই তারা একটা পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ করেছে। শুধু বাংলাদেশের জন্য তাদের অতিরিক্ত নিয়ম যুক্ত করতে হয়েছে সেই রুটিনে। তাদের রুটিনে লেখা আছে: হরতাল পলিসি ফর বাংলাদেশ। 
পলিসিটা বেশ বড়সড়। মোদ্দা কথা হলো, যদি ১২ ঘণ্টা হরতাল হয়, তাহলে দুপুরের পরীক্ষা সন্ধ্যার পরে, আর বিকেলের পরীক্ষা রাত ১২টায় শুরু হবে। আর হরতাল যদি ২৪ ঘণ্টার হয়, তাহলে এবারের পরীক্ষা বাতিল, সামনের বছর জানুয়ারিতে সেই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
হ্যাঁ, পরীক্ষার দিনে হরতাল ডাকা হয়েছে। হাজারও পরীক্ষার্থী আর তাদের উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা মধ্যরাতে পরীক্ষার হলে গেছেন। বাচ্চাদের যখন ঘুমের সময়, চোখ রগড়ে তারা তখন পরীক্ষা দিচ্ছিল, আর তাদের অভিভাবকেরা হলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে-বসে হাই তুলছিলেন।
পৃথিবীতে কত দেশ। কত বিচিত্র ধরনের মানুষ। এর মধ্যে একটা দেশই আছে, যারা নিয়মিতভাবে হরতাল করে। হরতাল জিনিসটা দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সর্বভারতীয় বন্ধ্ আজকাল আর ডাকা হয় বলে আমার জানা নেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা পশ্চিমবঙ্গে বন্ধ্ আহ্বান করে থাকেন। ভারতের একটা-দুটো রাজ্যে বন্ধ্ ডাকা হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেটা বছরে-দুবছরে এক-আধবার হতে পারে; নিয়মিতভাবে হরতাল, ‘লাগাতার হরতাল’, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত হরতাল’, ‘অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত হরতাল’—এসব এই একুশ শতকে পৃথিবীর আর কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে অহিংস পথে পরিচালিত করার জন্য হরতাল নামের এই গুজরাটি শব্দটি চালু করেছিলেন। ব্রিটিশরা চলে গেছে, মহাত্মারাও আজকাল আর পৃথিবীতে জন্মান না, কিন্তু হরতাল জিনিসটা পৃথিবীর সব দেশ থেকে উঠে গিয়ে এই বাংলাদেশে এসেই স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছে। 
ভূমিকম্প কখন আসবে, পূর্বাভাস দেওয়ার যন্ত্র বা প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়নি। আকাশে মেঘ দেখা দিলে ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়া যায়। সমুদ্র উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস সময় থাকতেই দিয়ে দেওয়া যায়, লোকজন সরেও যেতে পারে। কিন্তু ওই সাইক্লোন-জলোচ্ছ্বাসের আগমন প্রতিরোধ করা যায় না। হরতাল আমরা প্রতিরোধ করতে পারি না। কিন্তু আমরা এখন শিখে গেছি, বলতে পারি, কবে হরতাল হবে। বিএনপির ৩৩ জন নেতাকে আদালত থেকে কারাগারে পাঠানো হলো। সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে, ফোনে একটা কথাই বলাবলি হয়েছে, হরতালটা কবে, বৃহস্পতিবার, নাকি রোববার? সবাই জানে, হরতাল অনিবার্য। কবে আর কত দিনের জন্য, সকাল-সন্ধ্যা নাকি তারও বেশি, এটাই ছিল প্রশ্ন। হরতালের দিনের চেয়ে হরতালের আগের বিকেলটা বেশি ভয়াবহ। কারণ, বিকেলে গাড়িতে আগুন দেওয়া হবে। গাড়িতে দু-চারজন যাত্রী, চালক জীবন্ত দগ্ধ হবেন। এটাও আমাদের জানা। সর্বশেষ হরতালের আগের দিনেও তা-ই হলো। রাত নয়টার দিকে একজন মুঠোফোনে কথা বলছেন, আমি শুনছি, ‘না, না, এত রাতে আর গাড়ি পোড়াবে না, টেলিভিশনের খবরগুলো হয়ে গেছে, পত্রিকার সাংবাদিকেরাও এখন রাস্তায় নেই, এত রাতে গাড়ি পোড়ানোর কথা নয়, আপনি নিশ্চিন্তে চলে আসুন।’ 
কেন্দ্রীয় নেতাদের কারাগারে পাঠানোর আগের ঘটনা ইলিয়াস আলীর গুম হয়ে যাওয়া। এই পর্যায়ের একজন নেতাকে রাজপথ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে ড্রাইভারসমেত, তার গাড়ি পড়ে রইবে রাস্তায়, তার পরও বিরোধী দল চুপচাপ সেটা মেনে নেবে, এটা কেউ ভাবেনি। কাজেই দেশের মানুষ প্রস্তুত হয়েই ছিল, কবে হরতাল, কত দিনের জন্য হরতাল।
দেশের সাধারণ মানুষই বোঝে, কোন ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ায় হরতাল আসবে। অথচ সরকার তা জানে না, তা হয় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয়নি। সেটা হাতে পাওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে সংবিধান কেন সংশোধন করে ফেলা হলো, সেই বিস্ময় আমার যায় না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা তুলে দেওয়া হলে বিরোধী দলগুলো সেটা মানবে না, কাজেই তারা রাজপথে আন্দোলনে যাবে, সেটা যেকোনো বাচ্চা ছেলেও বোঝে। এই সংশোধনী তো সরকার তার ক্ষমতা-মেয়াদের একেবারে শেষ ভাগেও করতে পারত। তাড়াহুড়াটা কেন?
সরকারের নিশ্চয়ই অনেক সাফল্য আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও ব্যর্থতাও আসতে পারে। কিন্তু জেনেশুনে বিষপানের মতো ঘটনা একটার পর একটা কেন সরকার ঘটাচ্ছে, আমি অনেক চিন্তা করেও কোনো সমাধান পাই না। কতগুলো ইস্যু অপ্রয়োজনে তৈরি করে বিরোধী দলের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। যেসবের কোনো দরকারই ছিল না। ধরা যাক, বিদ্যুৎ-সমস্যার সমাধানে সরকার আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেছে, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র এনে সমস্যার দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করেছে; কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এটার সাফল্য-ব্যর্থতা এবং তার কারণ নিয়ে আমরা চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু বিরোধী দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে গাড়িতে আগুন দেওয়ার ঢালাও অভিযোগ এনে তাঁদের গ্রেপ্তার করার পরিণতি কী হবে, সেটা কি সরকার বোঝে না? এই সিদ্ধান্তগুলো কে নিচ্ছেন? কীভাবে নিচ্ছেন?
সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপির আচরণ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে আমাদের মাথা হেট হয়ে আসে। কারও পিএস টাকার থলি নিয়ে ধরা পড়েন, কারও বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তোলে এবং সব ধরনের লেনদেন বন্ধ করে দেয়। আচ্ছা, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক টাকা দেবে না, কাজেই আমরা মালয়েশিয়া থেকে টাকা আনব, তাতে যদি সুদের হার বেশি দিতে হয়, সেই অতিরিক্ত টাকাটা কে দেবে? সরকারের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, সেটা যদি কাল্পনিক আর বানোয়াটও হয়, তার দায় কেন জনগণ নেবে? সেই অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করে সহজ শর্তে তহবিল সংগ্রহের দায়িত্ব সরকারের, পাবলিকের নয়।
কোনো এমপির গাড়িতে গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়, কোনো এমপি জনতার উদ্দেশে পিস্তল উঁচিয়ে গুলি ছুড়ছেন, সেই ছবি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। সরকার ও প্রশাসনের চরম দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজে হতাশা প্রকাশ করেন। সর্বত্র দলীয়করণ, নিয়োগ-বাণিজ্য ও লুটপাট। এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে ভূমিদস্যুতার। স্কুলে বাচ্চা ভর্তি করানোর বিনিময়ে এমপি টাকা খান, লোক নিয়োগের নাম করে একই পদের বিপরীতে এলাকার একাধিক মানুষের কাছ থেকে টাকা খাওয়ার অভিযোগ ওঠে এমপির বিরুদ্ধে। একদিকে দেশ চালাতে গিয়ে নানা সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সরকারের ব্যর্থতাগুলো যেমন প্রকট হয়ে উঠছে, তেমনি কোনো কোনো মন্ত্রী-এমপি বা পদস্থের আচার-আচরণ সরকার-সমর্থকদের মুখে চুনকালি মেখে দিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিরোধ মোকাবিলায় সরকারের আচরণ অসহিষ্ণু, নিপীড়নমূলক ও অগণতান্ত্রিক। বুঝতাম তা যদি কার্যকর হতো। মানে বলতে চাচ্ছি, দমন-নিপীড়ন করেও যদি সরকার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারত, তবুও না হয় একটা সান্ত্বনা পাওয়া যেত। তা তো হচ্ছে না। নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এবং সরকারের একেকটা পদক্ষেপে তার জনপ্রিয়তায় একটা করে ধস নামছে।
যখন ব্যর্থতা আসে, তখন এমনি করেই আসে। একটার পর একটা ব্যর্থতার ঢেউ এসে আঘাত আনে। আর স্থানে স্থানে এমন সব কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে, মুখে চুনকালি পড়তে থাকে। তখন সরকারগুলো মরিয়া হয়ে ওঠে, বাজে বকতে থাকে, দমনপীড়নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং ভাবতে থাকে, আমার মতো শক্তিশালী জগতে আর কেউ নেই। আমার মতো জনপ্রিয়ও পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কিন্তু পায়ের নিচের মাটি সরতে থাকে। তারপর যখন সরকারের পতন হয়, তখন সেটা হয় খুবই করুণ, খুবই শোচনীয়।
ইতিহাস পুনরাবৃত্তিময়। ইতিহাসের শিক্ষা হলো, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।
এর মধ্যে রাজনীতিতে একটা সামান্য আশার আলো ফুটেছে। তা হলো, হরতালের বদলে বিরোধী দলের অনশন কর্মসূচিকে লোকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিও বলেছে, তারা হরতাল আহ্বান করতে চায় না। এই ছোট্ট আশাপ্রদ সূত্রটাকে ধরে উভয় পক্ষ কি এগিয়ে যেতে পারে না? সরকারের দিক থেকে সমঝোতার একটা চেষ্টা কি নেওয়া যায় না? রাজনৈতিক সমস্যার কোনো পুলিশি সমাধান নেই, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এটা না বোঝার মতো বোকা হতেই পারে না। সেখানেই আমাদের সামনে এক রহস্যময় ধাঁধা, রাজনৈতিক বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কি রাজনীতিকেরা নিচ্ছেন, নাকি অরাজনৈতিক কোনো উপদেষ্টা চক্রের হাতে পড়ে গেছে দেশ?
এই কলামের নাম ‘অরণ্যে রোদন’। কাজেই আমাকে অরণ্যে রোদন করে যেতেই হবে। রাজনৈতিক সংঘাত নিরসনে এগিয়ে আসুন। আরও দেড় বছর নির্বিঘ্নে দেশ চালনা করে সময়মতো নির্বাচন দিন। হরতাল আসতে পারে, এমন ঘটনা ঘটানো থেকে বিরত থাকুন।
আমি জানি, আমার এই কথা অরণ্যে রোদন মাত্র। একটা ভুল আরেকটা ভুল ডেকে আনে, একটা ভুল ঢাকার জন্য আরও ভুলের সিরিজ ডেকে আনা হয়।
আহা, এই দেশের সৃষ্টিশীল উদ্যমী মানুষগুলোর জন্য আমার কেবল মায়াই হয়, আফসোসই হয়। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কত বিরূপ, এর মধ্যেই কৃষকেরা বাম্পার ফসল ফলাচ্ছেন, শ্রমিকেরা-উদ্যোক্তারা-ব্যবসায়ীরা অর্থনীতির চাকা ঘোরাচ্ছেন, প্রবৃদ্ধি অর্জন করছেন। নিশাত মজুমদারেরা এভারেস্টে উঠে বাংলাদেশের পতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরছেন। আমাদের রাজনীতি যদি একটু মানুষবান্ধব হতো, আমরা কোথায় পৌঁছাতাম।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।


Monday, May 14, 2012

এক অক্ষম লেখকের আরেকটা ব্যর্থ রচনা

একটা সত্যি ঘটনা আপনাদের বলি। 
১৯৯৭ সাল। ২ অক্টোবর থেকে ভোরের কাগজ-এ প্রতিবেদক জায়েদুল আহসানের একটা ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে লাগল। বিষয়: ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর রহস্যময় সামরিক অভ্যুত্থান ও সৈনিকদের গণফাঁসি। 
২০ বছর আগের ঘটনায় যাঁদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের নামের তালিকা ভোরের কাগজ-এ প্রকাশিত হলো।
এই সময় ভোরের কাগজ-এর বাংলামোটর দপ্তরে এলেন একজন মা আর তাঁর যুবক পুত্র। 
এই নারীর স্বামী আজ থেকে ২০ বছর আগে নিখোঁজ হয়েছেন। তিনি জানেন না, তাঁর স্বামীর কী পরিণতি হয়েছে। তিনি কি বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। মারা গেলে কবে, কোথায় কীভাবে মারা গেছেন।
এই যুবক জানেন না, তাঁর বাবা কোথায়? বাবার কোনো স্মৃতিও তাঁর মনে নেই। 
তাঁরা শুনেছেন, ভোরের কাগজ-এ ফাঁসিপ্রাপ্ত সৈনিকদের নামের তালিকা ছাপা হয়েছে।
তাঁরা সেই কাগজটা দেখতে চান। 
তাঁরা জানতে চান, তাঁদের স্বামী/বাবার নাম এই তালিকায় আছে কি না।
তাঁরা ভোরের কাগজ অফিসের দোতলায় বসলেন। 
তাঁদের সামনে ভোরের কাগজ-এর উদ্দিষ্ট সংখ্যাটা মেলে ধরা হলো। তাঁরা দীর্ঘ তালিকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন।
তাঁদের বাবা/স্বামীর নাম পাওয়া গেল। তাঁরা জানলেন, ২০ বছর আগে তাঁদের প্রিয় মানুষটির ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয়েছে।
ছেলেটি বললেন, সামনেই বাবার মৃত্যুদিবস। এই বার আমরা তাঁর মৃত্যুর দিনটা পালন করতে পারব।
মা আর ছেলে ভোরের কাগজ অফিস থেকে ধীর পায়ে নেমে গেলেন।

২.
আসুন, আমরা আরেকটা কাহিনি নির্মাণ করি। একজন ২০ বছর বয়সের তরুণী। তাঁর নাম, ধরা যাক, নিলুফার বানু। তাঁর একটা ছেলে। নাম খোকা। খোকা কেবল হাঁটতে শিখেছে। দাদা, মামা, মাম—এ ধরনের কয়েকটা শব্দও খোকা বলতে পারে।
নিলুফারদের মধ্যবিত্ত পরিবার। বাড়িতে রঙিন টেলিভিশন, ফ্রিজ আছে। ব্যাংকে তাঁর স্বামীর জমানো টাকা আছে ১০-১৫ লাখ। স্বামী একটা ফ্ল্যাট কিনবেন বলে টাকা জমাচ্ছেন।
একদিন তাঁর স্বামী প্রতিদিনের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর ফিরে এলেন না।
নিলুফার কান্নাকাটি করলেন। মূর্ছা গেলেন কয়েকবার। থানা থেকে থানায় দৌড়ালেন। লাশ পাওয়া গেছে খবর পেলেই ছুটে গেলেন মর্গে। হাসপাতালে হাসপাতালে খবর নিলেন। পত্রিকায় নিখোঁজ স্বামীর ছবি ছাপা হলো। 
কিন্তু স্বামী ফিরে এলেন না।
ছেলে বড় হচ্ছে। তাঁদের সংসারও তো চালাতে হবে। নিলুফার ব্যাংকে গেলেন। বললেন, ব্যাংকের টাকাটা তুলতে হবে। আমাকে তিনি নমিনি করে গেছেন। আমি জানি। টাকাটা আমি তুলব।
ব্যাংকের ম্যানেজার তাঁকে দেখামাত্রই চিনলেন। বললেন, আপনার ঘটনা আমরা জানি। আমাদের সমবেদনা রইল। কিন্তু আপনার স্বামী যেহেতু মারা যাননি, কাজেই আপনি এই টাকা তুলতে পারবেন না। তিনি তো যেকোনো সময় ফিরে আসতে পারেন।
গ্রামে স্বামীর নামে দুই বিঘা জমি ছিল। নিলুফার ভাবলেন, জমিটা বিক্রি করে দেবেন।
কিন্তু তিনি তাও পারবেন না। কারণ, তাঁর স্বামী মারা যাননি। আইনত, তাঁকে এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে তাঁর স্বামীর ফিরে না আসার জন্য।
নিলুফারের বাবা-মা ভাবলেন, মেয়েকে আরেকবার বিয়ে দেওয়া দরকার।
কিন্তু সেটাও সম্ভব নয়। কারণ, নিলুফারের স্বামী মারা যাননি। নিখোঁজ হয়েছেন। বিয়ের পরের দিনই যদি খোকার বাবা ফিরে আসেন, তখন কী কাণ্ডটাই না ঘটবে।

৩.
প্রথম আলোর প্রথম পাতাতেই খবরটা ছাপা হয়েছিল। গুম বিষয়ে। একজন নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজন বিলাপ করে বলেছিলেন, এর চেয়ে ‘ক্রসফায়ার’ তো ভালো ছিল। নিশ্চিত হওয়া যেত যে মারা গেছে। কোথায়, কবে মারা গেছে তা-ও জানা যেত। লাশটাও পাওয়া যেত। কিন্তু এ যে ঘোরতর অনিশ্চয়তা!

৪.
কেন লিখি। কেন এই রকম লিখি। এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে আমি রবীন্দ্রনাথের ‘পুরস্কার’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিই।
বলি:
‘সংসার-মাঝে কয়েকটি সুর
রেখে দিয়ে যাব করিয়া মধুর,
দু-একটি কাঁটা করি দিব দূর—
তার পরে ছুটি নিব।
সুখহাসি আরো হবে উজ্জ্বল,
সুন্দর হবে নয়নের জল,
স্নেহসুধামাখা বাসগৃহতল
আরো আপনার হবে।
প্রেয়সী নারীর নয়নে অধরে
আরেকটু মধু দিয়ে যাব ভরে,
আরেকটু স্নেহ শিশুমুখ-’পরে 
শিশিরের মতো রবে।’
উদ্ধৃতি দেওয়াই সার। একটা কাঁটাও দূর করতে পারি না। একটা শিশুর মুখেও স্নেহের শিশির জোগাতে পারি না। স্নেহসুধায় আরেকটু আপনার করে তুলতে পারি না কোনো বাসগৃহতল।
কী যে খারাপ লাগে!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Monday, May 7, 2012

ঘা মারো, বাঁচাও


আজ পঁচিশে বৈশাখ। আজ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী বাংলাদেশে ও ভারতে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপিত হয়েছে, যৌথভাবেও। ভারত ও বাংলাদেশের অভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আছেন, যিনি বারবার করে বলেছেন, ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে, মুক্ত করো হে বন্ধ’। প্রতিবেশীর সঙ্গে, এমনকি অপ্রতিবেশীর সঙ্গেও বন্ধুত্বই লাভজনক। 
ভারত আর বাংলাদেশের বন্ধুত্বের মধ্যে এখন কাঁটাতারের বেড়া হয়ে আছে অপরিচয়ের দূরত্ব। এ দুই দেশের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বন্ধুত্বের, সুসম্পর্কের যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়, তা মরুপথে হারিয়ে যায়। তার একটা কারণ, অপরিচয়ের সংকট। মানুষে মানুষে যদি যোগাযোগ বাড়ে, আদান-প্রদান বৃদ্ধি পায়, তাহলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বন্ধুত্ব পোক্ত হবে, কার্যকর হবে।
আমরা ভারতকে যত জানি, ভারত আমাদের তত জানে না। আমরা ভারতের ছবি দেখি, টেলিভিশন চ্যানেল দেখি, গান শুনি, কলকাতার লেখকদের লেখা আমাদের মুখস্থ, এমনকি ভারতের ইংরেজি ভাষার লেখকেরা কে কোথায় কী করছেন, আমাদের অজানা নয়। ভারতের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশের সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। 
এ প্রসঙ্গ উঠেছিল গত ১৭ এপ্রিল প্রথম আলো আর ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়ার উদ্যোগে মৈত্রীবন্ধন শীর্ষক কর্মসূচির অংশ হিসেবে আসাদুজ্জামান নূর যখন কলকাতা টাউন হলে আবৃত্তি করতে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, তাঁর দলবলসমেত, রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা মিলিয়ে একটা কাব্যালেখ্যর নাটকীয় উপস্থাপনা নিয়ে। আবৃত্তির পরে আলোচনা। আসাদুজ্জামান নূরই প্রসঙ্গটা পাড়লেন। মুম্বাই থেকে কজন তরুণ এসেছিলেন বাংলাদেশে, ‘কে হতে চায় কোটিপতি’ অনুষ্ঠান নির্মাণের কাজে সহায়তা করতে। তাঁদের নূর নিমন্ত্রণ করেছিলেন তাঁর বাসভবনে। ওই তরুণদের একজন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যে এমন, তা আমাদের ধারণাই ছিল না।’ নূর তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে আপনারা কেমন ভেবেছিলেন?’ ওই তরুণ বলেছিলেন, কোনো মিডল ইস্টার্ন কান্ট্রির মতো। আসাদুজ্জামান নূর কলকাতার টাউন হল মঞ্চে তাই বললেন, কলকাতার চেয়ে ভারতের অন্য রাজ্যে এ ধরনের অনুষ্ঠান বেশি বেশি করা দরকার।
একজন দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে আসাদুজ্জামান নূরের এ বক্তব্য সমর্থন করে তাঁর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগলেন, সাধারণ ভারতীয়রা বাংলাদেশ সম্পর্কে কত কম জানে, বা কত ভুল জানে। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত অবশ্য সেই দর্শককে বললেন, আপনার অভিজ্ঞতাই শেষ কথা নয়, এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই আগ্রহ পোষণ করেন, যাঁরা বাংলাদেশের সাহিত্য-শিল্প-নাটকের খোঁজখবর রাখেন। যেমন রুদ্র নিজেই তা করে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ যদিও বলেছিলেন, ‘অচেনাকে ভয় কি আমার ওরে? অচেনাকে চিনে চিনে উঠবে জীবন ভরে’। তবু মনে হয়, বাংলাদেশকে কম জানা, বা না জানা দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ভারতের শীর্ষ পর্যায়ে এবং বাংলাদেশের বহু পর্যায়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নত করার জন্য সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা যায়, ভারতের আমলাতন্ত্রে উদ্যোগগুলো আটকে যায়। চুক্তি হয়, প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়, কিন্তু কার্যকর হয় না। ঋণ দেওয়ার কথা ঘোষিত হয়, টাকাটা আসে না। 
১৬ এপ্রিল কলকাতার টাউন হল মঞ্চে সাহিত্য নিয়ে আলোচনা ও পাঠের আয়োজনে ছিলেন ভারতের নমিতা গোখলে আর বাংলাদেশের সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। আমিও ছিলাম। আমি বললাম, এক দিন আগে পয়লা বৈশাখ সারা বাংলাদেশে কী বিপুলভাবে, কী মহাড়ম্বরে উদ্যাপিত হয়েছে, আপনারা যদি জানতেন! লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়। ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে, প্রতিটা পার্কে, রমনায়, ধানমন্ডি লেকের ধারে, চন্দ্রিমা উদ্যানে, মিলনায়তনে, সারা বাংলাদেশের প্রতিটা শহরে কত যে মঞ্চ, কত যে অনুষ্ঠান, আর কোনোটাতেই লোকের কোনো অভাব নেই। আপনারা কলকাতায় বসে এটা কল্পনাও করতে পারবেন না। 
আমাদের পয়লা বৈশাখ আমরা সংগ্রাম করে অর্জন করেছি। 
যেমন আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অর্জন করে নিয়েছি সংগ্রাম করে। ষাটের দশকে যখন রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বার্ষিকী পালনে বাধা এল, তখন আমরা সেই বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করে রবীন্দ্রনাথকে নিজেদের করে নিয়েছি, সে জন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসা, অশ্রু, স্বেদ আর রক্তের মাধ্যমে অর্জিত রবীন্দ্রনাথ। এর তাৎপর্য ভারতবাসী বুঝবে কি না, আমি জানি না।
কিন্তু আমাদের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আমাদের মধ্যে দূরত্ব দূর করুক। দুই দেশের বন্ধুত্বকে দুই দেশের মানুষের জন্য উপকারের ক্ষেত্র দিক। রবীন্দ্রনাথ মিলনের কথা বলেছেন, এমনকি মুক্তধারা নাটকে সরাসরি এবং রূপকার্থে বলেছেন নদীতে বাঁধ দেওয়ার ক্ষতির কথা, বলেছেন বাঁধ ভেঙে দেওয়ার কথা, সে কথাও আমরা স্মরণ করব—
‘বিভূতি: ... আমার বাঁধ সম্পূর্ণ হয়েছে।
দূত: শিবতরাইয়ের প্রজারা এখনও জানে না। তারা বিশ্বাসই করতে পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন, কোনো মানুষ তা বন্ধ করতে পারে।’
প্রকৃতির গতিকে রুদ্ধ করার পরিণতি ভালো হয় না। 
ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি ঢাকা সফর করলেন। উপলক্ষ এই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে যাবে না ফিরে, এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।’ সেই দেওয়া-নেওয়া উভয়ের ক্ষেত্রে সমতার ভিত্তিতে, সমমর্যাদার ভিত্তিতে হোক।
একই সময়ে এসেছিলেন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। 
এটিএন বাংলার সাংবাদিক জ ই মামুন হিলারিকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানির সুযোগ চায়—এ রকম অনেক দাবি আছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে কী চায়? হিলারি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ দুই গণতান্ত্রিক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে অন্য কিছু চায় না। যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায়, একটা গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভালো করছে, এগিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি।
তিনি আমাদের অতিথি। অতিথির কথার পিঠে আমরা কথা বলি না। আমাদের সংস্কৃতি হলো, অতিথিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখানো। 
শুধু মনে পড়ে, পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার আগেই, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্শাল প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রু ম্যানের কাছে একটা চিঠি লিখেছিলেন। তাতে বলা হয়েছিল, ‘১৫ আগস্ট ১৯৪৭ পাকিস্তান রাষ্ট্র বলে একটা নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমের একটা বড় অংশ আর দক্ষিণ-পূর্ব দিকের একটা ছোট অংশ নিয়ে। ৭৫ মিলিয়ন লোকের পাকিস্তান হবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিম রাষ্ট্র, আর এটা হবে রণকৌশলের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।’
পাকিস্তানের জন্মের আগেই তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে তাঁরা বন্ধুত্ব করবেন। কারণ, এটা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রণকৌশল-সংক্রান্ত এলাকা।
সেই বন্ধুত্বের পরিণাম কী হয়েছে, আমরা জানি। এখনো পাকিস্তানকে ভুগতে হচ্ছে।
আমেরিকা সারা পৃথিবীতে যেখানেই গেছে, নিজের স্বার্থেই গেছে। তাদের কাছে সন্ত্রাসবাদের একটা মানে আছে, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের সংজ্ঞা তারা নিজেদের দেশে নিজেদের নাগরিকদের জন্য যে মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করে, সেই একই মাপকাঠিতে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতেও পরিমাপ করে, এ রকম ভাবার কোনো বাস্তব কারণ আছে কি?
শঙ্খ ঘোষ তাঁর বটপাকুড়ের ফেনা বইয়ে একটা নিবন্ধ লিখেছেন, ‘অন্যের ভালো করা।’ ১৯৬৭ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার ৫০০ জন প্রকাশক ও পাঠাগার পেশাজীবী প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে এক চিঠি লেখেন। বলেন, ‘আসুন, আমরা আমাদের তরুণদের পৃথিবীর আরেক প্রান্তে নিহত হওয়ার জন্য পাঠানো বন্ধ করি। আসুন, আমরা ভিয়েতনামের মানুষ আর অর্থনীতি ধ্বংস করা বন্ধ করি।’
তখন জন আপডাইক নামের একজন ঔপন্যাসিক বলেছিলেন, ‘আই অ্যাম ফর আওয়ার ইনভেনশন ইফ ইট ডাজ সাম গুড।’ যদি এতে ভালো হয়, তাহলে আমি সৈন্য প্রেরণ বা হস্তক্ষেপের পক্ষে।
শঙ্খ ঘোষ বলছেন, ‘অন্যের ভালো করার এই মহান দায়িত্ব পরের ৪০ বছর পরে জুড়েও সমানভাবেই চলছে।’
যা-ই হোক, আমেরিকার সঙ্গেও আমাদের বন্ধুত্ব আমাদের স্বার্থেই দরকার। আমেরিকার সঙ্গে আমাদের রয়েছে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা, আর তা হলো আমরা আমেরিকায় রপ্তানি করি, আমেরিকা থেকে আমদানি করি খুব কম। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান খাত তৈরি পোশাকের বড় বাজার আমেরিকা। অন্য কোনো কারণে না হোক, শুধু এ কারণে আমাদের উচিত এমন কিছু না করা, যাতে আমেরিকা ক্ষুব্ধ হয়। এটা আমেরিকার স্বার্থে নয়, আমাদের স্বার্থেই প্রয়োজন।
আমার দুঃখ কী জানেন! আমরা কতগুলো সমস্যা নিজেরা অকারণে তৈরি করলাম। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সারা পৃথিবীতে সম্মানিত মানুষ, তাঁকে আমরা বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম। তা না করে তাঁকে হেনস্তা করা হলো অকারণে। আজ কানাডা বা বিশ্বব্যাংক আমাদের মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বা তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলে। আমাদের মানবাধিকার-পরিস্থিতি নিয়ে অতিথিরা কথা বলছেন, এ পরিস্থিতি আমরা নিজেরা তৈরি করেছি। এ সুযোগ আমরা তাঁদের করে দিয়েছি। 
আল্লাহ তা’আলা তো সে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করে না, যে জাতি নিজেদের ভাগ্য নিজেরা পরিবর্তন করে না।
আমাদের রাজনীতি ও বাস্তবতা দেখে মনে হয়, আমরা চাই না দেশে শান্তি থাকুক, আমরা চাই না দেশে স্থিতিশীলতা থাকুক। সেখানে অন্যরা এলেন, বললেন, চলে গেলেন, জয় করলেন কি করলেন না, তাতে কী এসে যায়!
হিলারি ক্লিনটন অনেকটা সময় দিয়েছেন বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে। বলেছেন, ওইখানেই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। সেটা তাঁরা না বললেও আমরা জানি। বাংলাদেশের সমস্ত সম্ভাবনার মূলে তার কোটি কোটি তরুণ। যারা সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, যারা এগিয়ে আসছে। যাদের বেশির ভাগই পড়ে বাংলা মাধ্যমে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরিয়ে যারা এগিয়ে আসছে, যারা হাজারে হাজারে জিপিএ ফাইভ পায়। যাদের কাছে পয়লা বৈশাখের তাৎপর্য খুবই নিত্তনৈমিত্তিক, যাদের কাছে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই রেখেছেন,
‘বাহির পানে তাকায় না যে কেউ
দেখে না যে বান ডেকেছে
জোয়ার-জলে উঠছে প্রবল ঢেউ।
চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে
মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলে,
আছে অচল আসনখানা মেলে।
যে যার উচ্চ আপন বাঁশের মাচায়,
আয় অশান্ত আয় রে আমার কাঁচা।’
তাই তো তরুণদের উদ্দেশে রবীন্দ্রনাথের ডাক,
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা,
ওরে সবুজ ওরে অবুঝ
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।
আমরা প্রবীণেরা যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমরা বাঁচব না, সবাই মিলে আত্মহত্যা করব, তখন ওই সবুজ তরুণেরাই যদি আমাদের বাঁচায়।

আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।