আনিসুল হক
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আমাদের গ্রামের বাড়ি। আগে ওই এলাকায় কার্তিক মাসে আকাল পড়ত, ওই গ্রামের বহু লোক অনাহারে-অর্ধাহারে থাকত। এখন কার্তিকের সেই মঙ্গা আর আমাদের গ্রামে নেই। এর একটা কারণ হলো, আমাদের গ্রামে এখন কলার চাষ হয়। কার্তিক মাসে কলা ওঠে, সেটা বেচে এলাকাবাসী অন্ন জোগাড় করতে পারে। আগে কেন তাহলে কলার চাষ হতো না? এখন কেন হয়? কারণ, যমুনা সেতু। আমাদের গ্রামে খড়ের ঘরগুলো টিনের ঘর হয়ে গেছে। একটা সেতু একটা জনপদের চেহারা পাল্টে দিতে পারে, এটা আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম।
পদ্মা সেতু যে আমাদের খুবই দরকার, এটা সবাই জানে। ২০১০ সালেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ ভাগ বাড়িয়ে দেবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য পদ্মা সেতু জিডিপি বাড়াবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে এই সেতুর দ্বারা। জিডিপি বাড়লে উপকৃত হবে পুরো দেশ, দেশের ১৬ কোটি মানুষ। দেশের ওই অঞ্চলটা এখন সবচেয়ে গরিব। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করাও তো আমাদের কর্তব্য। তারও পরে পদ্মা সেতুর সঙ্গে যুক্ত আছে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নটি, সোজা কথায় ভারতের জন্য ট্রানজিট।
পদ্মা সেতু যে আমাদের দরকার, সেটা আমরা খুব ভালোভাবে জানি, বিশ্বব্যাংকও জানে, আর জানে বলেই তারা অর্থ বরাদ্দ করতে এগিয়ে এসেছিল। এখন তারা অর্থ বরাদ্দ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। কারণ, তারা দুর্নীতির অভিপ্রায়ের প্রমাণ পেয়েছে এবং সেটা উচ্চপর্যায়ে।
এইখানে এই পুরোনো গল্পটি আপনাদের মনে করিয়ে দিই। সন্তান কার, এই নিয়ে ঝগড়া বেধেছে দুই মহিলার। দুজনই দাবি করছেন, সন্তান তাঁর। কাজির আদালতে বিচারপ্রার্থী হলেন দুজনেই। কাজি বললেন, বাচ্চাটাকে তরবারি দিয়ে মাঝ বরাবর দু-টুকরো করো, তারপর দুজনকেই অর্ধেকটা করে দিয়ে দাও। একজন বললেন, ঠিক আছে, আপনি বাচ্চা ওকেই দিয়ে দিন। আমার বাচ্চা লাগবে না। কাজি বললেন, একেই বাচ্চা দিয়ে দাও, এই হলো প্রকৃত মা। প্রকৃত মা তাঁর সন্তানের কোনো ক্ষতি চান না।
বিশ্বব্যাংকের কী যায়-আসে, যদি বাংলাদেশের মানুষ গরিবই থেকে যায়, এক অঞ্চলের মানুষের চলাচলে ও জীবনযাপনে অসুবিধা হয়, তারা বৈষম্যের শিকার হয়। আসবে-যাবে আমাদের। কারণ, এ যে আমাদের দেশ, এই প্রকল্প যে আমাদের নিজেদের প্রকল্প।
আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসে, অনেক টাকা-পয়সা খরচাপাতি করে, সম্ভাব্যতা যাচাই, ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ দান, নকশা চূড়ান্তকরণ—সব সম্পন্ন করে তো এখন বলতে পারব না, খেলব না। এ তো আমাদের জন্য ছেলেখেলা নয় যে খেললাম খেললাম, না-খেললাম, চলে গেলাম। হে বালকগণ, তোমাদের জন্য যা ছেলেখেলা, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা।
যেহেতু মাথা আমার, তাই মাথাব্যথাও আমার। সেখানেই আমাদের উচিত ছিল, বিষয়টা পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা। বিশ্বব্যাংক কোনো ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তাদের বিশেষজ্ঞরাও পৃথিবীজুড়ে সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন, কথাটা তেমনও নয়। বিশ্বব্যাংকের বিষয়ে বহু সমালোচনা আছে, তার কতকটা নীতিগত, কতকটা আচরণগত। পদ্মা সেতু নিয়ে তারা যে একটা চীনা কোম্পানির পক্ষে জোর সুপারিশ করছিল, যারা পূর্ব-অভিজ্ঞতার প্রমাণ হিসেবে ভুয়া ছবি দাখিল করেছিল, নিজেদের কাজ হিসেবে চীনের সেতু দেখিয়ে ছবি জমা দিয়েছিল আমেরিকার এক সেতুর, সেটা ধরাও পড়ে—সে কথা এখন আমাদের মন্ত্রীও জানাচ্ছেন, এই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক প্যানেলের চেয়ারম্যান জামিলুর রেজা চৌধুরীও সেটা লিখে জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সন্দেহ নিরসনে আমরা অসাধারণ সব পদক্ষেপ নিয়েছি।’ অর্থাৎ আমাদের সরকার সব সময়েই চেয়েছে, এবং এখনো চাইছে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে না যাক, তারা এবং তার সঙ্গে অন্য উন্নয়ন-সহযোগীরা পদ্মা সেতুতে তহবিল জোগাক। আপাতত, সরকারের এসব ‘অসাধারণ পদক্ষেপ’-এর ফল কী? বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এখন বাংলাদেশের সামনে বিকল্প করণীয় কী? এক. বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া, তাদের বুঝিয়ে রাজি করানো, বাতিলকে বাতিল করে প্রকল্প আবার সচল করা। দুই. বিকল্প উৎস থেকে টাকা জোগাড় করা। আমরা জানি, বিকল্প উৎস আসলে নেই, দেশে এত বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় নেই, আর বিশ্বব্যাংকের মতো নামমাত্র সুদে ও বহু বছরের মেয়াদে আর কোনো উৎস থেকে তহবিল জোগাড় করা যাবে না।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ যে বলছে, কোনো রকমের দুর্নীতি হয়নি বা দুর্নীতির কোনো সাক্ষী নেই, এ কথাটা কি দেশের মানুষ বিশ্বাস করে? আমার নিজের ধারণা, দুর্নীতিতে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়নের কণ্টকমুকুটশোভা যার মাথায়, ‘আমরা কোনো রকমের দুর্নীতি করি নাই, করতে চাইও নাই’—তার এ রকম দাবি সত্য হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
ঘুরেফিরে কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের কথাই আসে। বিশ্বব্যাংক নাকি তাঁর পাসপোর্ট আর ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বলেছিল। ওদিকে খোলাখুলি না হলেও ঘুরেফিরে ইনিয়ে-বিনিয়ে, সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের উত্থাপিত প্রশ্নের মধ্যে কথাটা এসে যাচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্থা না করার যে অনুরোধ আমেরিকার পক্ষ থেকে করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের কাছে, তাতে কর্ণপাত না করার কোনো প্রভাব পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত কি না! অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর জানা নেই।
এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের নেতৃত্ব বিষয়ে আমার বক্তব্য দুটো। এক. আমরা কি খুব একগুঁয়েমি দিয়ে চালিত হচ্ছি? সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর সময় একটা জোর আওয়াজ উঠেছিল যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের। ওই সময়, ঈদের প্রাক্কালে দেখা গেল, আমাদের মহাসড়কগুলো খানাখন্দময়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে বাসমালিকেরা বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। সেটাই ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের আদর্শ সময়। ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে ভারতের রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করেন, নিশ্চয়ই তিনি নিজের রেলগাড়ি চালাচ্ছিলেন না, সিগন্যালও তিনি ওঠান-নামান না, তবু তিনি পদত্যাগ করেন, এটা বোঝাতে যে সরকার জেগে আছে, তাদের বিবেক ক্রিয়াশীল আছে। আমাদের দেশে মনে হয়, গন্ডারের চামড়া আমাদের, বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো, মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলো। এক আবুল হোসেনকে মন্ত্রীর পদে রেখে দেওয়া কি তিন কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের চেয়েও জরুরি? আমি বলছি না, আবুল হোসেন দুর্নীতি করেছেন, কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য তাঁকেই মানুষ দায়ী বলে ভাবে, এটা মানুষের ধারণা, মানুষের ধারণা প্রমাণ-সাক্ষী দিয়ে চলে না, একটা ভাবমূর্তি জনসমক্ষে নানা কারণে নানাভাবে তৈরি হয়েই যায়। কাজেই আবুল হোসেন যে কেবল পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তা নয়, তিনি তো এই সরকারের ভোট ও জনসমর্থনের জন্যও একটা বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিন কোটি লোকের স্বার্থ বা পদ্মা সেতু তো পরের প্রসঙ্গ, এই সরকার কি আরেকবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চায় না? এই রহস্য আজও অনুদ্ঘাটিতই রয়ে গেল, কেন একজন মাত্র মানুষকে মন্ত্রী করে রাখাটা এত জরুরি হয়ে পড়ল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদি তদন্তের স্বার্থের কথা বলে পদত্যাগ করতে পারেন, তাহলে আবুল হোসেন ‘যেহেতু বিতর্ক উঠেছে, তাই তদন্তের স্বার্থে আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করছি’ বলে কেন সরে দাঁড়ালেন না। তারপর তদন্তে যদি প্রমাণিত হতো, তিনি অহেতুক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, আমরা গিয়ে তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে আসতে পারতাম।
অনেক সময় মনে হয়, সরকার নিজেকে খুবই শক্তিশালী মনে করে। হিলারি ক্লিনটনের সফরের পরপরই তাঁর সমালোচনা এমন তীব্রভাবে আমাদের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা করতে লাগলেন, মনে হতে লাগল, আমেরিকা প্রতিবছর বাংলাদেশের কাছে ভিক্ষার থলে নিয়ে এসে হাজির হয়। যেন বাংলাদেশ পৃথিবীর একটা সুপার পাওয়ার, আর আমেরিকা একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এ-জাতীয় কথামালার যে কোনো মানে হয় না, সেটা আমরা সবাই জানি।
এখন মনে হচ্ছে, বেশ একটা জেদাজেদির মধ্যে পড়ে গেছে পদ্মা সেতু। তার শিকার হচ্ছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশে বলা যায়, তিনজন মাত্র লোকের জন্য তো একটা দেশের ১৬ কোটি মানুষ দুর্ভোগ পোহাতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের উপকারে আসে এমন প্রকল্প সম্পন্ন হতে সাহায্য করা, কয়েকজন মাত্র মানুষের জন্য কোটি মানুষের প্রকল্প থেকে ‘খেললাম না’ বলে চলে যাওয়া নয়। বিশ্বব্যাংকও ভুল করে। বিশ্বব্যাংকের সুবিধা হলো, বাংলাদেশে তারা আইন প্রণয়ন করিয়ে নিতে পেরেছে, তাদের কোনো আচরণের জন্য বাংলাদেশের আইনে তাদের ধরা যাবে না। বাংলাদেশের নেতা-কর্মী-আমলা-পেশাজীবী কারোরই তো সেই ঢাল নেই।
আর সরকারকে বলব, আবুল হোসেন কী করেছেন, কী করেননি বা প্রকল্প পরিচালক কী করেছেন, কী করেননি, তার দায় তো জনগণের নয়। দেশের ১৬ কোটি মানুষের ওপরে কেন আপনি উচ্চ হারে সুদের ঋণ চাপিয়ে দেবেন? আপনার লোকদের ভাবমূর্তি খারাপ, তার দায়িত্ব তো ১৬ কোটি মানুষ বহন করতে পারে না।
আর দেশের সার্বিক ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? শুধু এই এক প্রকল্পে নয়, জাইকা, এডিপি অন্য প্রকল্পেও টাকা ছাড় দেওয়া স্থগিত করে রেখেছে। শুধু টাকার অঙ্কেই বা কেন ক্ষতি বিবেচনা করব, আমাদের সম্মানের যে ক্ষতি হয়েছে, তার দায় তো নেতাদের নিতেই হবে।
পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। জিদ ধরে বসে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। চোরের ওপরে রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মানে হয় না। তিনজন মানুষকে বসিয়ে দিলে বা সরিয়ে দিলে যদি পদ্মা সেতু হয়, সেটা করাই কি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় ছিল না?
এখন তো পুরো ব্যাপারটা বেশ লেজেগোবরে হয়ে গেছে। এখন বিচারিক তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত তো অপরিহার্য। দোষী কাউকে পাওয়া গেলে তাকে শাস্তিও দিতে হবে। আর না পাওয়া গেলে তো কোনো কথাই নেই।
অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দেশের সম্মান রক্ষার কথা। অর্থমন্ত্রী নিশ্চিত যে, ‘দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, কোনোমতেই সেগুলো সঠিক নয়।’ অর্থমন্ত্রী যেহেতু নিশ্চিত, সে ক্ষেত্রে খুব নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া জরুরি।
অর্থমন্ত্রী আরেকটা খুব মূল্যবান কথা বলেছেন। ‘আশা করব, দেশের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে সজাগ থাকবেন।’ দেশের সম্মান রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আমাকে একজন শিল্পোদ্যোক্তা, যার বিশাল এক শিল্পোদ্যোগের তহবিল একই কারণে আটকে আছে, দুঃখ করে বলেছিলেন, সারা পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় মুখর আর বাংলাদেশে কয়েকটা লোকের কথিত দুর্নীতির অভিপ্রায়ের কারণে ১৬ কোটি লোকের প্রকল্প বিশ্বব্যাংক আটকে দিচ্ছে, আপনারা তার প্রতিবাদ করছেন না কেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে আমাদের গ্রামের বাড়ি। আগে ওই এলাকায় কার্তিক মাসে আকাল পড়ত, ওই গ্রামের বহু লোক অনাহারে-অর্ধাহারে থাকত। এখন কার্তিকের সেই মঙ্গা আর আমাদের গ্রামে নেই। এর একটা কারণ হলো, আমাদের গ্রামে এখন কলার চাষ হয়। কার্তিক মাসে কলা ওঠে, সেটা বেচে এলাকাবাসী অন্ন জোগাড় করতে পারে। আগে কেন তাহলে কলার চাষ হতো না? এখন কেন হয়? কারণ, যমুনা সেতু। আমাদের গ্রামে খড়ের ঘরগুলো টিনের ঘর হয়ে গেছে। একটা সেতু একটা জনপদের চেহারা পাল্টে দিতে পারে, এটা আমরা চোখের সামনে ঘটতে দেখলাম।
পদ্মা সেতু যে আমাদের খুবই দরকার, এটা সবাই জানে। ২০১০ সালেও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বলেছে, পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ ভাগ বাড়িয়ে দেবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য পদ্মা সেতু জিডিপি বাড়াবে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে এই সেতুর দ্বারা। জিডিপি বাড়লে উপকৃত হবে পুরো দেশ, দেশের ১৬ কোটি মানুষ। দেশের ওই অঞ্চলটা এখন সবচেয়ে গরিব। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করাও তো আমাদের কর্তব্য। তারও পরে পদ্মা সেতুর সঙ্গে যুক্ত আছে আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রশ্নটি, সোজা কথায় ভারতের জন্য ট্রানজিট।
পদ্মা সেতু যে আমাদের দরকার, সেটা আমরা খুব ভালোভাবে জানি, বিশ্বব্যাংকও জানে, আর জানে বলেই তারা অর্থ বরাদ্দ করতে এগিয়ে এসেছিল। এখন তারা অর্থ বরাদ্দ করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। কারণ, তারা দুর্নীতির অভিপ্রায়ের প্রমাণ পেয়েছে এবং সেটা উচ্চপর্যায়ে।
এইখানে এই পুরোনো গল্পটি আপনাদের মনে করিয়ে দিই। সন্তান কার, এই নিয়ে ঝগড়া বেধেছে দুই মহিলার। দুজনই দাবি করছেন, সন্তান তাঁর। কাজির আদালতে বিচারপ্রার্থী হলেন দুজনেই। কাজি বললেন, বাচ্চাটাকে তরবারি দিয়ে মাঝ বরাবর দু-টুকরো করো, তারপর দুজনকেই অর্ধেকটা করে দিয়ে দাও। একজন বললেন, ঠিক আছে, আপনি বাচ্চা ওকেই দিয়ে দিন। আমার বাচ্চা লাগবে না। কাজি বললেন, একেই বাচ্চা দিয়ে দাও, এই হলো প্রকৃত মা। প্রকৃত মা তাঁর সন্তানের কোনো ক্ষতি চান না।
বিশ্বব্যাংকের কী যায়-আসে, যদি বাংলাদেশের মানুষ গরিবই থেকে যায়, এক অঞ্চলের মানুষের চলাচলে ও জীবনযাপনে অসুবিধা হয়, তারা বৈষম্যের শিকার হয়। আসবে-যাবে আমাদের। কারণ, এ যে আমাদের দেশ, এই প্রকল্প যে আমাদের নিজেদের প্রকল্প।
আমরা অনেকটা পথ এগিয়ে এসে, অনেক টাকা-পয়সা খরচাপাতি করে, সম্ভাব্যতা যাচাই, ভূমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ দান, নকশা চূড়ান্তকরণ—সব সম্পন্ন করে তো এখন বলতে পারব না, খেলব না। এ তো আমাদের জন্য ছেলেখেলা নয় যে খেললাম খেললাম, না-খেললাম, চলে গেলাম। হে বালকগণ, তোমাদের জন্য যা ছেলেখেলা, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা।
যেহেতু মাথা আমার, তাই মাথাব্যথাও আমার। সেখানেই আমাদের উচিত ছিল, বিষয়টা পেশাদারি দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করা। বিশ্বব্যাংক কোনো ধোয়া তুলসী পাতা নয়। তাদের বিশেষজ্ঞরাও পৃথিবীজুড়ে সব সমস্যার সমাধান করে দিচ্ছেন, কথাটা তেমনও নয়। বিশ্বব্যাংকের বিষয়ে বহু সমালোচনা আছে, তার কতকটা নীতিগত, কতকটা আচরণগত। পদ্মা সেতু নিয়ে তারা যে একটা চীনা কোম্পানির পক্ষে জোর সুপারিশ করছিল, যারা পূর্ব-অভিজ্ঞতার প্রমাণ হিসেবে ভুয়া ছবি দাখিল করেছিল, নিজেদের কাজ হিসেবে চীনের সেতু দেখিয়ে ছবি জমা দিয়েছিল আমেরিকার এক সেতুর, সেটা ধরাও পড়ে—সে কথা এখন আমাদের মন্ত্রীও জানাচ্ছেন, এই প্রকল্পের আন্তর্জাতিক প্যানেলের চেয়ারম্যান জামিলুর রেজা চৌধুরীও সেটা লিখে জানিয়েছেন।
বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। অর্থমন্ত্রী সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংকের সন্দেহ নিরসনে আমরা অসাধারণ সব পদক্ষেপ নিয়েছি।’ অর্থাৎ আমাদের সরকার সব সময়েই চেয়েছে, এবং এখনো চাইছে, বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু থেকে সরে না যাক, তারা এবং তার সঙ্গে অন্য উন্নয়ন-সহযোগীরা পদ্মা সেতুতে তহবিল জোগাক। আপাতত, সরকারের এসব ‘অসাধারণ পদক্ষেপ’-এর ফল কী? বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু ঋণচুক্তি বাতিল করেছে। এখন বাংলাদেশের সামনে বিকল্প করণীয় কী? এক. বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া, তাদের বুঝিয়ে রাজি করানো, বাতিলকে বাতিল করে প্রকল্প আবার সচল করা। দুই. বিকল্প উৎস থেকে টাকা জোগাড় করা। আমরা জানি, বিকল্প উৎস আসলে নেই, দেশে এত বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় নেই, আর বিশ্বব্যাংকের মতো নামমাত্র সুদে ও বহু বছরের মেয়াদে আর কোনো উৎস থেকে তহবিল জোগাড় করা যাবে না।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ যে বলছে, কোনো রকমের দুর্নীতি হয়নি বা দুর্নীতির কোনো সাক্ষী নেই, এ কথাটা কি দেশের মানুষ বিশ্বাস করে? আমার নিজের ধারণা, দুর্নীতিতে বেশ কয়েকবার চ্যাম্পিয়নের কণ্টকমুকুটশোভা যার মাথায়, ‘আমরা কোনো রকমের দুর্নীতি করি নাই, করতে চাইও নাই’—তার এ রকম দাবি সত্য হলেও কেউ বিশ্বাস করবে না।
ঘুরেফিরে কিন্তু সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের কথাই আসে। বিশ্বব্যাংক নাকি তাঁর পাসপোর্ট আর ব্যাংক হিসাব জব্দ করতে বলেছিল। ওদিকে খোলাখুলি না হলেও ঘুরেফিরে ইনিয়ে-বিনিয়ে, সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের উত্থাপিত প্রশ্নের মধ্যে কথাটা এসে যাচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হেনস্থা না করার যে অনুরোধ আমেরিকার পক্ষ থেকে করা হয়েছিল বাংলাদেশ সরকারের কাছে, তাতে কর্ণপাত না করার কোনো প্রভাব পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পদক্ষেপের সঙ্গে যুক্ত কি না! অর্থমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর জানা নেই।
এই অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের নেতৃত্ব বিষয়ে আমার বক্তব্য দুটো। এক. আমরা কি খুব একগুঁয়েমি দিয়ে চালিত হচ্ছি? সড়ক দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরের মৃত্যুর সময় একটা জোর আওয়াজ উঠেছিল যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের। ওই সময়, ঈদের প্রাক্কালে দেখা গেল, আমাদের মহাসড়কগুলো খানাখন্দময়। ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে বাসমালিকেরা বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলেন। সেটাই ছিল সৈয়দ আবুল হোসেনের পদত্যাগের আদর্শ সময়। ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটলে ভারতের রেলমন্ত্রী পদত্যাগ করেন, নিশ্চয়ই তিনি নিজের রেলগাড়ি চালাচ্ছিলেন না, সিগন্যালও তিনি ওঠান-নামান না, তবু তিনি পদত্যাগ করেন, এটা বোঝাতে যে সরকার জেগে আছে, তাদের বিবেক ক্রিয়াশীল আছে। আমাদের দেশে মনে হয়, গন্ডারের চামড়া আমাদের, বকো আর ঝকো, কানে দিয়েছি তুলো, মারো আর ধরো, পিঠে বেঁধেছি কুলো। এক আবুল হোসেনকে মন্ত্রীর পদে রেখে দেওয়া কি তিন কোটি মানুষের ভাগ্যবদলের চেয়েও জরুরি? আমি বলছি না, আবুল হোসেন দুর্নীতি করেছেন, কিন্তু যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জন্য তাঁকেই মানুষ দায়ী বলে ভাবে, এটা মানুষের ধারণা, মানুষের ধারণা প্রমাণ-সাক্ষী দিয়ে চলে না, একটা ভাবমূর্তি জনসমক্ষে নানা কারণে নানাভাবে তৈরি হয়েই যায়। কাজেই আবুল হোসেন যে কেবল পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য একটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তা নয়, তিনি তো এই সরকারের ভোট ও জনসমর্থনের জন্যও একটা বড় দায় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তিন কোটি লোকের স্বার্থ বা পদ্মা সেতু তো পরের প্রসঙ্গ, এই সরকার কি আরেকবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে চায় না? এই রহস্য আজও অনুদ্ঘাটিতই রয়ে গেল, কেন একজন মাত্র মানুষকে মন্ত্রী করে রাখাটা এত জরুরি হয়ে পড়ল। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদি তদন্তের স্বার্থের কথা বলে পদত্যাগ করতে পারেন, তাহলে আবুল হোসেন ‘যেহেতু বিতর্ক উঠেছে, তাই তদন্তের স্বার্থে আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করছি’ বলে কেন সরে দাঁড়ালেন না। তারপর তদন্তে যদি প্রমাণিত হতো, তিনি অহেতুক অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, আমরা গিয়ে তাঁকে ফুলের মালা দিয়ে আসতে পারতাম।
অনেক সময় মনে হয়, সরকার নিজেকে খুবই শক্তিশালী মনে করে। হিলারি ক্লিনটনের সফরের পরপরই তাঁর সমালোচনা এমন তীব্রভাবে আমাদের দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা করতে লাগলেন, মনে হতে লাগল, আমেরিকা প্রতিবছর বাংলাদেশের কাছে ভিক্ষার থলে নিয়ে এসে হাজির হয়। যেন বাংলাদেশ পৃথিবীর একটা সুপার পাওয়ার, আর আমেরিকা একটা তৃতীয় বিশ্বের দেশ। এ-জাতীয় কথামালার যে কোনো মানে হয় না, সেটা আমরা সবাই জানি।
এখন মনে হচ্ছে, বেশ একটা জেদাজেদির মধ্যে পড়ে গেছে পদ্মা সেতু। তার শিকার হচ্ছে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাংকের উদ্দেশে বলা যায়, তিনজন মাত্র লোকের জন্য তো একটা দেশের ১৬ কোটি মানুষ দুর্ভোগ পোহাতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের উপকারে আসে এমন প্রকল্প সম্পন্ন হতে সাহায্য করা, কয়েকজন মাত্র মানুষের জন্য কোটি মানুষের প্রকল্প থেকে ‘খেললাম না’ বলে চলে যাওয়া নয়। বিশ্বব্যাংকও ভুল করে। বিশ্বব্যাংকের সুবিধা হলো, বাংলাদেশে তারা আইন প্রণয়ন করিয়ে নিতে পেরেছে, তাদের কোনো আচরণের জন্য বাংলাদেশের আইনে তাদের ধরা যাবে না। বাংলাদেশের নেতা-কর্মী-আমলা-পেশাজীবী কারোরই তো সেই ঢাল নেই।
আর সরকারকে বলব, আবুল হোসেন কী করেছেন, কী করেননি বা প্রকল্প পরিচালক কী করেছেন, কী করেননি, তার দায় তো জনগণের নয়। দেশের ১৬ কোটি মানুষের ওপরে কেন আপনি উচ্চ হারে সুদের ঋণ চাপিয়ে দেবেন? আপনার লোকদের ভাবমূর্তি খারাপ, তার দায়িত্ব তো ১৬ কোটি মানুষ বহন করতে পারে না।
আর দেশের সার্বিক ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াল? শুধু এই এক প্রকল্পে নয়, জাইকা, এডিপি অন্য প্রকল্পেও টাকা ছাড় দেওয়া স্থগিত করে রেখেছে। শুধু টাকার অঙ্কেই বা কেন ক্ষতি বিবেচনা করব, আমাদের সম্মানের যে ক্ষতি হয়েছে, তার দায় তো নেতাদের নিতেই হবে।
পলিটিকস ইজ দি আর্ট অব কম্প্রোমাইজ। জিদ ধরে বসে থাকা কোনো কাজের কথা নয়। চোরের ওপরে রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মানে হয় না। তিনজন মানুষকে বসিয়ে দিলে বা সরিয়ে দিলে যদি পদ্মা সেতু হয়, সেটা করাই কি রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় ছিল না?
এখন তো পুরো ব্যাপারটা বেশ লেজেগোবরে হয়ে গেছে। এখন বিচারিক তদন্ত কমিটির মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত তো অপরিহার্য। দোষী কাউকে পাওয়া গেলে তাকে শাস্তিও দিতে হবে। আর না পাওয়া গেলে তো কোনো কথাই নেই।
অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দেশের সম্মান রক্ষার কথা। অর্থমন্ত্রী নিশ্চিত যে, ‘দুর্নীতি বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে যে কথাগুলো বলা হয়েছে, কোনোমতেই সেগুলো সঠিক নয়।’ অর্থমন্ত্রী যেহেতু নিশ্চিত, সে ক্ষেত্রে খুব নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত হওয়া জরুরি।
অর্থমন্ত্রী আরেকটা খুব মূল্যবান কথা বলেছেন। ‘আশা করব, দেশের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে সজাগ থাকবেন।’ দেশের সম্মান রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। আমাকে একজন শিল্পোদ্যোক্তা, যার বিশাল এক শিল্পোদ্যোগের তহবিল একই কারণে আটকে আছে, দুঃখ করে বলেছিলেন, সারা পৃথিবীতে বুদ্ধিজীবী ও নাগরিক সমাজ বিশ্বব্যাংকের সমালোচনায় মুখর আর বাংলাদেশে কয়েকটা লোকের কথিত দুর্নীতির অভিপ্রায়ের কারণে ১৬ কোটি লোকের প্রকল্প বিশ্বব্যাংক আটকে দিচ্ছে, আপনারা তার প্রতিবাদ করছেন না কেন?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।