Tuesday, June 12, 2012

তর্ক হচ্ছে কেন?

আনিসুল হক 


চলতি বাজেটে সরকার কথার ওপর ট্যাকসো বসাবে—এই রকম একটা হেডলাইন দেখে আমার হেডের হেডলাইটগুলো উঠল জ্বলে, বেহেড অবস্থায় পড়ে ফেললাম, ‘টক শোর ওপর ট্যাকসো’। সেই রকমটা হলে মন্দ হতো না, যদি টক শোতে কিংবা সাংবাদিকদের মাইক্রোফোনের সামনে কথা বললেই ট্যাক্স দিতে হতো! ভালো কথা বললে সেই ট্যাক্স ফিরিয়েও দেওয়া যাবে, তবে ফাউল কথা বললে ট্যাক্সের ফাইল মোটাই হতে থাকবে। কিন্তু খবরটা একটু যত্ন করে পড়ার পর বোধোদয় হলো, ট্যাকসোটা টক শো-ওয়ালাদের জন্য নয়, বাংলাদেশের ৬-৭ কোটি মোবাইল গ্রাহকের ট্যাক থেকে টাকা বের করার জন্য। ওই মোবাইল গ্রাহকদের মধ্যে বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ, সেটা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানবিদ হতে হয় না, কারণ দেশে কোটিপতির সংখ্যা আর যাই হোক, ৬-৭ কোটি নয়। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে! কিন্তু এই দেশে কি তর্ক করা যায়? এই দেশে এখন একটাই সংলাপ, ‘তর্ক হচ্ছে কেন?’
কথার ওপর কর বসানোর পক্ষে আমি। জানি, কথাটা শুনতে খারাপ, কারণ তাতে মনে হয়, আমি বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছি। বাকস্বাধীনতা না থাকলে আমাদের সবাইকে নির্বাক হয়ে থাকতে হবে, সে হবে খুবই একটা অবাক ব্যাপার। কিন্তু ভুল কথা বলার চেয়ে কথা না বলাই কি শ্রেয় নয়?
আমরা অনবরত ভুল কথা বলে চলেছি বা ভুল বকে চলেছি। আমাদের কথার লাগাম নেই, তাই বুঝি আগাম কথা বলার ওপর আগাম ট্যাকসো বসানোর চেষ্টা চলছে, অন্তত মুঠোফোনে। মোবাইলে মোবাইলে যে কথা হয়, সে তো কানাকানি, কানে কানে কথা, তাতে দুজনের কর্ণপীড়া হতে পারে, আমাদের মর্মপীড়া হয় না। কিন্তু টেলিভিশনে, টক শোয়, আলোচনা অনুষ্ঠানে, আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে টেলিভিশন সাংবাদিকদের বাড়িয়ে দেওয়া মাইক্রোফোনে, সংসদে আমরা যেসব কথা বলি, তাতে কি অনেক সময় ভুল-বোঝাবুঝি, সেখান থেকে ঠোকাঠুকি, তার পর তা নিয়ে সর্বসাধারণের মাতামাতি, শেষতক পুলিশে-মানুষে হাতাহাতি হয় না? আমার নিজের ধারণা, কথা কম বলাই সর্বোত্তম। 
ভালো কথা অবশ্য শুনতে ভালোই লাগে। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কথা বললে সেই কথা হাঁ করে শুনতে হয়। কিন্তু সবাই কি আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যে তার কথা শুনতে ভালো লাগবে?
কথা তো বলতে জানতেও হয়। আর সবচেয়ে বেশি করে জানতে হয় থামতে। কোন জায়গায় থামতে হবে, তাও আমরা অনেক সময় জানি না। 
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সুনাম ছিল এসব ব্যাপারে। 
একবার তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করলেন,
‘প্রিয় কমরেড, ভাইসব, সাম্রাজ্যবাদের দালালগণ।’
পুরো সভা স্তব্ধ।
তিনি বলে চলেছেন, ‘কৃত চক্রান্তে দেশ হুমকিগ্রস্ত। তাদের কুকীর্তি এই কমিউজম, এই সমাজতন্ত্র। এই শ্রমিক-সংহতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।’
তখন তাঁর উপদেষ্টা এগিয়ে এলেন। এবং পুরো বাক্যটা ঠিকভাবে তাঁর কানে পড়ে দিলেন।
‘প্রিয় কমরেড ভাইসব,
সাম্রাজ্যবাদের দালালগণ কৃত চক্রান্তে দেশ হুমকিগ্রস্ত। তাদের কুকীর্তি এই কমিউনিজম, এই সমাজতন্ত্র, এই শ্রমিক-সংহতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।’
এই কৌতুক আমাদের দেশের একজন নেতাকে নিয়েও প্রচলিত ছিল।
তিনি নাকি বলেছিলেন,
‘ভাইসব, আপনারা গরু-ছাগল। আপনারা ভেড়া-মোষ। আপনারা হাঁসমুরগি। চাষ করুন।’
ব্রেজনেভকে নিয়ে আরও মজার মজার কথা প্রচলিত আছে। একবার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ ছয় ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এর কারণ তিনি তাঁর বক্তৃতার কার্বন কপিও পড়ে শুনিয়েছিলেন।
আরেকবার জীবনের শেষভাগে দক্ষিণ রাশিয়ায় এক বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ব্রেজনেভ। সেখানে তাঁকে ভাষণ দিতে হবে। বিজ্ঞানের ওপর লেখা ভাষণের বদলে তিনি তুলে নেন সংগীতের ওপর লিখিত বক্তৃতা। তিনি সেই বক্তৃতার গোটাটাই পড়ে শুনিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা পিনপতন নিস্তব্ধতায় সেই ভাষণ শ্রবণ করেছিলেন। 
আমার ধারণা, এটা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের বক্তৃতার চেয়ে ভালো হয়েছিল। জ্ঞানী জৈল সিং বিজ্ঞানী সম্মেলনে গিয়ে বলেছিলেন, আপনারা নাকি বলেন মানুষের পূর্বপুরুষ বানর ছিল। শোনেন, আপনাদের পূর্বপুরুষ বানর হতে পারে, আমার পূর্বপুরুষ মানুষই ছিল।
জ্ঞানী জৈল সিং নিয়ে আরেকটা কৌতুক। তিনি একবার শেক্সপিয়ারের ওপর আয়োজিত একটা সেমিনারে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, শেক্সপিয়ারের একটা খুব বিখ্যাত নাটক হলো, টেক ইট দেয়ার (বাংলায়: উঠিয়ে নাও)।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ‘টেক ইট দেয়ার’ নামে তো শেক্সপিয়ারের কোনো নাটক নেই।
তখন জ্ঞানী জৈল সিং বললেন, ‘আমি তো অনুবাদে পড়েছি। কথাটা ছিল, ওঠে-লো (Othello)।’
আমাদের দেশেও নানা প্রকার কথা দিয়ে অনেকেই চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ‘আল্লাহ্র মাল আল্লাহ্ নিয়ে গেছে’ থেকে শুরু করে ‘কম কম খান’, ‘হায়াত উঠে গিয়েছিল’, ‘পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন’, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো’ ইত্যাদি। 
এসব কথার ওপর ট্যাকসো না ধরে পুরস্কার ঘোষণা করা উচিত। এগুলো হলো লাখ কথার এক কথা। 
বেশি কথা বলার শাস্তি প্রকৃতিই আমাদের দিয়ে থাকে। মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা। নীরবতা হীরন্ময়। এবং পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে অনেকেই ভুলে যান। আর পুলিশের সঙ্গে বাক্য বিনিময় করা বা পুলিশের সামনে যুক্তি পেশ করার মতো বোকামিও মানুষ কখনো কখনো করে ফেলতে পারে। কিন্তু তার পরিণতি কী হতে পারে, আমরা তা ভুলে যাই। যেমন ভুলে গিয়েছিলেন একজন বিচারক। তিনি একজন জেলা যুগ্ম দায়রা জজ। তাঁর অপরাধ তিনি নিজ আদালত চত্বরে ঢুকছিলেন। পুলিশ তাঁর ব্যাগ তল্লাশি করতে চায়। বিচারক মহোদয় নিজের পরিচয় দেন। তখন পুলিশ তাঁর আইডি কার্ড দেখতে চায়। তিনি ইতস্তত করছিলেন। হয়তো তিনি বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে তিনিই বিচারক, কাজেই তাঁর পরিচয়পত্র দেখানোটা বাহুল্য। তিনি পরিচয়পত্র বের করেন। কিন্তু এই যে বাক্যবিনিময়, যুক্তি খণ্ডন ও পরিবেশন, অর্থাৎ কিনা তর্ক, তা তো পছন্দ নয় আমাদের পুলিশের। অন্য একজন পুলিশ সদস্য তেড়ে আসেন, তর্ক হচ্ছে কেন। পুলিশের হেলমেট আর লাঠির বাড়ি, কিলঘুষি সব পড়তে থাকে এই মাননীয় বিচারকের দেহের ওপর। 
আমরাও তাই বলি। তর্ক হচ্ছে কেন? তর্ক হবে কেন? আমরা তর্ক পছন্দ করি না। 
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments:

Post a Comment