Tuesday, June 19, 2012

কুড়ি বছর পরের বাংলাদেশ


আনিসুল হক

আজ থেকে কুড়ি বছর পরে, ২০৩২ সালে, কেমন হবে বাংলাদেশ? 
আজকের সংবাদপত্র খুলে কোথাও কোনো আশা দেখতে পাই না। আশুলিয়ায় পোশাক তৈরির কারখানাগুলো বন্ধ, শ্রমিকেরা রাস্তায়, প্রাণপণ লড়াই করছে পুলিশের সঙ্গে। সংবাদপত্রের শিরোনাম, আশুলিয়া-কাঁচপুর রণক্ষেত্র। এসব শিরোনাম আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে, শব্দ তার প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য হারিয়েছে, রণক্ষেত্র মানে যে যুদ্ধের ময়দান, এই কথাটা আমরা, পাঠকেরা খুব আর ভেবে দেখি না। অন্যদিকে, শেয়ার মার্কেটের হতাশ বিনিয়োগকারীরা রাস্তায় বসে পড়েছেন। খবরে প্রকাশ, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার ছেড়ে যাচ্ছেন। মহাসড়কে খানাখন্দ। সড়ক দুর্ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক, তার ওপর যানজট। ঢাকা শহর চলে না, কিন্তু ঢাকা থেকে বাইরেও যাওয়া কষ্টকর। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বা খুলনা বা রাজশাহী বা সিলেট বা ময়মনসিংহ যাত্রা করলে গন্তব্যে কখন পৌঁছানো যাবে, কেউ বলতে পারে না। অন্যদিকে, টিআইবির বার্ষিক সাধারণ সভায় ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে দুর্নীতির ব্যাপকতায়’ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। আরেকটি সেমিনারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেছেন, ‘বাংলাদেশে শুধু অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি নয়, আন্তর্জাতিক দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। দেশের বড় বড় দুর্নীতিবাজ শাস্তি না পেয়ে উল্টো পুরস্কৃত হচ্ছেন বলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।... দেশীয় দুর্নীতিবাজদের অনৈতিকতা ও অবক্ষয়কে রাষ্ট্র থেকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, কুইক রেন্টালে ব্যাপক দুর্নীতি হলেও এ নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না নির্দেশ রয়েছে। এ জন্য এ খাতের অবস্থা এখন যথেচ্ছা হয়ে পড়েছে।’ (দৈনিক যুগান্তর, ১৮ জুন ২০১২) মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ এখন দুর্নীতিবাজদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের বস্তা বাঁধতে ব্যস্ত, দেশ শেষ হয়ে যাক, মানুষ নিশ্চিহ্ন হোক; পরিবেশ, ও আবার কোন বালাই! এটা সলিমুদ্দি-কলিমুদ্দির মনোভাব হলে এক; কিন্তু শীর্ষস্থানীয়রা, ক্ষমতাবানেরা যখন কেবল নিজের পোঁটলাটা সামলাতে ব্যস্ত, তখন আশার আর কোনো জায়গা থাকে না। তখন সবকিছু ভেঙে পড়ে! তখন রাস্তাঘাট অচল হয়ে পড়ে, পুলিশ কথা শোনে না, বাতি জ্বলে না, সেতুর জায়গায় সেতু গড়ে ওঠে না। আমরা কেবল দুর্নীতিবাজ নই, আমরা অদক্ষও। বছর শেষে বাজেট ফিরে যায়, কারণ আমরা খরচ করতে পারি না। বাজেট যাতে ফিরে না যায়, সে জন্য তড়িঘড়ি করে প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় এবং হরিলুট হয়। 
দেশটা আসলে চলছে না। কিন্তু তবু তো চলছেই। খেয়েপরে বেঁচেই তো আছি। বাজারে গেলে তো চাল-ডাল কিনতেও পারি। আবার টাকা দিলে তো দোকানি জিনিসপাতি দেয়ও। এখনো তো এই নৈরাজ্য আসেনি, টাকা দিলাম, বললাম, দু কেজি চাল দাও, দোকানি গলা ধাক্কা দিয়ে বলল, টাকা দিলেই চাল দিতে হবে, এটা মগের মুল্লুক নাকি! এই যে বলছি, দেশ চলছে না, আবার বলছি চলছে, এই কথাটার মানে হলো, দেশের চাকা ঘোরাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশের মেহনতি কৃষক। স্বাধীনতার সময়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছিল, এখন জনসংখ্যা তার দ্বিগুণ, কিন্তু কী বিপ্লবটাই না ঘটে গেছে কৃষিক্ষেত্রে, বছরে তিন ফসল, মাছ চাষে বিপ্লব, পোলট্রি খাতে বিপ্লব, এ কি যা-তা কথা। কাজ করছেন আমাদের উদ্যোক্তারা, ব্যবসায়ীরা, কারিগরেরা, শ্রমিকেরা। বিচিত্র ব্যবসা, বিচিত্র শিল্পোদ্যোগ। আর আছেন আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা, যাঁরা বহু কষ্টে বিদেশে যান, ততোধিক কষ্ট করে আয় করেন এবং দেশে টাকা পাঠান। এই যে প্রতিটা মানুষের নিজস্ব উদ্যোগ, এটাই দেশের চাকাটা ঘোরাচ্ছে। আর আমরা, কতিপয় স্বার্থভোগী মানুষ, এই সাধারণ পরিশ্রমী সৎ মানুষের পথচলাটাকে প্রতিনিয়ত থামিয়ে দিয়ে বলছি, টাকা দাও। আমাদের কোটি কোটি টাকা দরকার। দাও দাও। আমাদের কর্তব্য ছিল তাদের চলার পথটা মসৃণ করব, তাদের চলার গতিটা ত্বরান্বিত করব, নির্বিঘ্ন করব, কিন্তু করছি উল্টোটা। দেশে যে যথাসময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় না, দেশে যে পদ্মা সেতু হয় না, সে দোষ তো গরিব দেশবাসীর নয়! কিন্তু ভুগতে হবে তাদেরই।
এ অবস্থায় আশা কোথায়?
দুই বছর পরে দেশটার কী হবে? যথাসময়ে নির্বাচন হবে? সেই নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে? ফলটা মোটামুটি গ্রহণীয় হবে, জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন ঘটবে নির্বাচনে? আমাদের মুদ্রার যে মাত্র দুটো পিঠ, দুই পিঠই তো আমরা দেখে ফেলেছি। আমরা যে বারবার ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপিত হচ্ছি। সেই কথাটা ভাবলেও তো চোখেমুখে অন্ধকার ছাড়া কিছু দেখি না। বাংলাদেশের মানুষের সামনে বাছাই করে নেওয়ার জন্য আছে দুটো দল বা জোট, হয় বিএনপি, নয়তো আওয়ামী লীগ। দুবার করে উভয়ের শাসনই দেখা হলো! তবু তো জনগণ পাঁচ বছর পর পর ভোট দিয়ে ক্ষমতায় কে যাবে নির্ধারণ করার মালিক ছিল, জনতার সেই ক্ষমতাটাও আদৌ থাকবে তো! আমাদের নেতাদের কথাবার্তা, হাবে-ভাবে বোঝা যায়, তাঁরা মনে করেন, তাঁরা খুব ভালো দেশ চালাচ্ছেন বা অতীতে চালিয়েছেন, তাঁদের আচার-আচরণ পরিবর্তনের কোনো কারণ ঘটেনি।
এ অবস্থায় আগামী পাঁচ বছর পরের বাংলাদেশটা কেমন হবে, কল্পনা করতে পারি না। দশ বছর পরের বাংলাদেশ কেমন হবে, হয়তো কল্পনা করা যায়, কিন্তু কল্পনা করার সাহস পাই না। একমাত্র উপায় হলো, কল্পনায় বিশ বছর পরের বাংলাদেশটাকে দেখা।
সেদিন অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান, বিনায়ক সেন, আকবর আলি খান এসেছিলেন প্রথম আলোর কার্যালয়ে, বাজেট নিয়ে কথা বলতে। ড. মোস্তাফিজুর রহমানই বললেন, ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে সাত বছরে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়, আজকে যদি মাথাপিছু আয় ৮০০ ডলার হয়, সাত বছর পরে হবে ১৬০০ ডলার, ১৪ বছর পরে ৩২০০ ডলার, ২১ বছর পরে ৬৪০০ ডলার। সেটা একটা কল্পনা হতে পারে। আরেকটা কল্পনা হলো, শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া তখন অবসরে যাবেন। তখন দেশটার নেতৃত্ব কার হাতে থাকবে। আমাদের উপমহাদেশের ইতিহাসে রাজনীতিতে পারিবারিক পরিচয়ই তো সবচেয়ে বড় উপাদান। 
থাক। কল্পনা করতে পারছি না। রংপুরে গিয়েছিলাম জিপিএ-৫ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে। ২৩০০ ছেলেমেয়ের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। এরা সবাই মাধ্যমিক পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো ফলটুকু অর্জন করে নিয়েছে। একজন বক্তৃতা করল, সে তিস্তা নদের জেলের ছেলে। সারা রাত বাবার সঙ্গে মাছ ধরে সকালবেলা ফিরেছে। বাবা বাজারে গিয়ে মাছ বেচে চাল কিনে ফিরেছেন, তারপর পরিবারের সবার খাবার জুটেছে। শিক্ষা একটা জাদুর কাঠি। কলকাতা থেকে কত দূরে ছিল বিদ্যাসাগরের বাড়ি, সেই যে হেঁটে হেঁটে মাইলফলক দেখে ধারাপাত শিখেছেন, আর কলকাতায় যে বাড়ির বারান্দায় আশ্রয় পেয়েছিলেন, তাতে তাঁর পা পুরোটো মেলা যেত না। কিন্তু লেখাপড়া শিখে কেবল নিজে পাল্টে গেলেন না, সমাজটাকে পাল্টানোর ব্রতও তো গ্রহণ করলেন। পায়রাবন্দের রোকেয়া বাড়ির নিষেধ উপেক্ষা করে ইংরেজি আর বাংলা পড়তেন বলেই না আজ বাংলাদেশের নারীরা এতটা এগিয়ে! ৯০ ভাগের বেশি ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, আশি হাজারেরও বেশি ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিশ বছর পর এই বাচ্চাদের বয়স হবে ৩৬-৩৭। ওরা দায়িত্ব নেবে এই দেশটা গড়ার। ওরা কৃষক হলে ভালো কৃষক হবে, শ্রমিক হলে লেখাপড়া জানা শ্রমিক হবে। ওদের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে নতুন দিনের দেশ গড়ার কারিগরেরা। ওরা অনেকেই বিদেশ যাবে এবং পাঠাবে মূল্যবান বিদেশি মুদ্রা, আর পাঠাবে তার চেয়েও মূল্যবান জ্ঞান, প্রযুক্তি, আইডিয়া।
পুঁজি গড়ে ওঠার কালে নৈরাজ্য হয়, লুটপাট হয়। কিন্তু পুঁজি গড়ে ওঠার পরে নিজের স্বার্থেই নিজেকে পাহারা দেয়, তার তখন দরকার হয় আইনের শাসন। সেটা কি কুড়ি বছর পরে পাব না?
অন্যদিকে, সর্বব্যাপী লুটপাট, তার সঙ্গে ক্ষমতায় থাকার ওতপ্রোত সম্পর্ক আমাদের রাজনীতিকে করে তুলেছে সংঘাতময়, সেটা কত ভয়াবহ পর্যায় পর্যন্ত যাবে, আমরা জানি না। আইভরি কোস্টে দুজন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীই নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছিলেন, তারপর দুজনেই শপথ নিয়ে ফেলেছিলেন, তারপর শুরু হয়েছিল দুই পক্ষের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই। আমরা কি সেই রকম সংঘর্ষের দিকে যাব? একটা ব্যাখ্যা হলো, আফ্রিকায় কৃষিসভ্যতাই আসেনি, আমরা কৃষিসভ্যতাটা পেয়েছিলাম। কাজেই একেবারে পুরোপুরি ব্যর্থ একটা রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোনো আশঙ্কা আমাদের নেই। 
যে জাতি যে রকম, সেই জাতি সেই রকম নেতাই তৈরি করে। কিন্তু এই জাতি তো একদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা, তাজউদ্দীন আহমদের মতো সংগঠক পেয়েছিল। সময়ও তো মানুষ তৈরি করে। আমরা কি একজন যোগ্য নেতা পাব না? নাকি যোগ্য নেতা পাওয়ার মতো যোগ্যতা এই জাতির হয়নি! দুঃখে আমার প্রাণ ফেটে যায়, যখন দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা চিকিৎসক বা প্রকৌশলীর মতো শিক্ষিত মানুষ নির্লজ্জ দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় শামিল হন! কিন্তু তারও চেয়ে অধিক দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের নেতারা এই প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, কে কত বড়লোক হতে পারেন, কে কত কামিয়ে নিতে পারেন। না, বর্তমান নিয়ে শোক আর করব না! 
ভবিষ্যতের স্বপ্নই দেখি। একটা নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে। তাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে দুনিয়া-সেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার, তারা এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওড়ায় দেশের পতাকা। তারা ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পোদ্যোগ, শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে আসছে নতুন নতুন ভাবনা নিয়ে, সৃজনশীলতা নিয়ে। 
তারা নিশ্চয়ই যোগ্য নেতা পাওয়ার যোগ্যতা নিয়েই বেড়ে উঠছে, এগিয়ে আসছে।
আজ থেকে বিশ বছর পরে বাংলাদেশ যে একটা উন্নত আলোকিতসম্পন্ন বাংলাদেশ হবে, এটা একটা গাণিতিক বাস্তবতা। 
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Tuesday, June 12, 2012

তর্ক হচ্ছে কেন?

আনিসুল হক 


চলতি বাজেটে সরকার কথার ওপর ট্যাকসো বসাবে—এই রকম একটা হেডলাইন দেখে আমার হেডের হেডলাইটগুলো উঠল জ্বলে, বেহেড অবস্থায় পড়ে ফেললাম, ‘টক শোর ওপর ট্যাকসো’। সেই রকমটা হলে মন্দ হতো না, যদি টক শোতে কিংবা সাংবাদিকদের মাইক্রোফোনের সামনে কথা বললেই ট্যাক্স দিতে হতো! ভালো কথা বললে সেই ট্যাক্স ফিরিয়েও দেওয়া যাবে, তবে ফাউল কথা বললে ট্যাক্সের ফাইল মোটাই হতে থাকবে। কিন্তু খবরটা একটু যত্ন করে পড়ার পর বোধোদয় হলো, ট্যাকসোটা টক শো-ওয়ালাদের জন্য নয়, বাংলাদেশের ৬-৭ কোটি মোবাইল গ্রাহকের ট্যাক থেকে টাকা বের করার জন্য। ওই মোবাইল গ্রাহকদের মধ্যে বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ, সেটা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানবিদ হতে হয় না, কারণ দেশে কোটিপতির সংখ্যা আর যাই হোক, ৬-৭ কোটি নয়। এই নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে! কিন্তু এই দেশে কি তর্ক করা যায়? এই দেশে এখন একটাই সংলাপ, ‘তর্ক হচ্ছে কেন?’
কথার ওপর কর বসানোর পক্ষে আমি। জানি, কথাটা শুনতে খারাপ, কারণ তাতে মনে হয়, আমি বাকস্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছি। বাকস্বাধীনতা না থাকলে আমাদের সবাইকে নির্বাক হয়ে থাকতে হবে, সে হবে খুবই একটা অবাক ব্যাপার। কিন্তু ভুল কথা বলার চেয়ে কথা না বলাই কি শ্রেয় নয়?
আমরা অনবরত ভুল কথা বলে চলেছি বা ভুল বকে চলেছি। আমাদের কথার লাগাম নেই, তাই বুঝি আগাম কথা বলার ওপর আগাম ট্যাকসো বসানোর চেষ্টা চলছে, অন্তত মুঠোফোনে। মোবাইলে মোবাইলে যে কথা হয়, সে তো কানাকানি, কানে কানে কথা, তাতে দুজনের কর্ণপীড়া হতে পারে, আমাদের মর্মপীড়া হয় না। কিন্তু টেলিভিশনে, টক শোয়, আলোচনা অনুষ্ঠানে, আলোচনা অনুষ্ঠান শেষে টেলিভিশন সাংবাদিকদের বাড়িয়ে দেওয়া মাইক্রোফোনে, সংসদে আমরা যেসব কথা বলি, তাতে কি অনেক সময় ভুল-বোঝাবুঝি, সেখান থেকে ঠোকাঠুকি, তার পর তা নিয়ে সর্বসাধারণের মাতামাতি, শেষতক পুলিশে-মানুষে হাতাহাতি হয় না? আমার নিজের ধারণা, কথা কম বলাই সর্বোত্তম। 
ভালো কথা অবশ্য শুনতে ভালোই লাগে। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ কথা বললে সেই কথা হাঁ করে শুনতে হয়। কিন্তু সবাই কি আর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ যে তার কথা শুনতে ভালো লাগবে?
কথা তো বলতে জানতেও হয়। আর সবচেয়ে বেশি করে জানতে হয় থামতে। কোন জায়গায় থামতে হবে, তাও আমরা অনেক সময় জানি না। 
সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভের সুনাম ছিল এসব ব্যাপারে। 
একবার তিনি বক্তৃতা আরম্ভ করলেন,
‘প্রিয় কমরেড, ভাইসব, সাম্রাজ্যবাদের দালালগণ।’
পুরো সভা স্তব্ধ।
তিনি বলে চলেছেন, ‘কৃত চক্রান্তে দেশ হুমকিগ্রস্ত। তাদের কুকীর্তি এই কমিউজম, এই সমাজতন্ত্র। এই শ্রমিক-সংহতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।’
তখন তাঁর উপদেষ্টা এগিয়ে এলেন। এবং পুরো বাক্যটা ঠিকভাবে তাঁর কানে পড়ে দিলেন।
‘প্রিয় কমরেড ভাইসব,
সাম্রাজ্যবাদের দালালগণ কৃত চক্রান্তে দেশ হুমকিগ্রস্ত। তাদের কুকীর্তি এই কমিউনিজম, এই সমাজতন্ত্র, এই শ্রমিক-সংহতিকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।’
এই কৌতুক আমাদের দেশের একজন নেতাকে নিয়েও প্রচলিত ছিল।
তিনি নাকি বলেছিলেন,
‘ভাইসব, আপনারা গরু-ছাগল। আপনারা ভেড়া-মোষ। আপনারা হাঁসমুরগি। চাষ করুন।’
ব্রেজনেভকে নিয়ে আরও মজার মজার কথা প্রচলিত আছে। একবার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ ছয় ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এর কারণ তিনি তাঁর বক্তৃতার কার্বন কপিও পড়ে শুনিয়েছিলেন।
আরেকবার জীবনের শেষভাগে দক্ষিণ রাশিয়ায় এক বিজ্ঞান সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ব্রেজনেভ। সেখানে তাঁকে ভাষণ দিতে হবে। বিজ্ঞানের ওপর লেখা ভাষণের বদলে তিনি তুলে নেন সংগীতের ওপর লিখিত বক্তৃতা। তিনি সেই বক্তৃতার গোটাটাই পড়ে শুনিয়েছিলেন। বিজ্ঞানীরা পিনপতন নিস্তব্ধতায় সেই ভাষণ শ্রবণ করেছিলেন। 
আমার ধারণা, এটা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংয়ের বক্তৃতার চেয়ে ভালো হয়েছিল। জ্ঞানী জৈল সিং বিজ্ঞানী সম্মেলনে গিয়ে বলেছিলেন, আপনারা নাকি বলেন মানুষের পূর্বপুরুষ বানর ছিল। শোনেন, আপনাদের পূর্বপুরুষ বানর হতে পারে, আমার পূর্বপুরুষ মানুষই ছিল।
জ্ঞানী জৈল সিং নিয়ে আরেকটা কৌতুক। তিনি একবার শেক্সপিয়ারের ওপর আয়োজিত একটা সেমিনারে বক্তৃতা করতে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, শেক্সপিয়ারের একটা খুব বিখ্যাত নাটক হলো, টেক ইট দেয়ার (বাংলায়: উঠিয়ে নাও)।
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ‘টেক ইট দেয়ার’ নামে তো শেক্সপিয়ারের কোনো নাটক নেই।
তখন জ্ঞানী জৈল সিং বললেন, ‘আমি তো অনুবাদে পড়েছি। কথাটা ছিল, ওঠে-লো (Othello)।’
আমাদের দেশেও নানা প্রকার কথা দিয়ে অনেকেই চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ‘আল্লাহ্র মাল আল্লাহ্ নিয়ে গেছে’ থেকে শুরু করে ‘কম কম খান’, ‘হায়াত উঠে গিয়েছিল’, ‘পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকুন’, ‘দেশের আইনশৃঙ্খলা যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো’ ইত্যাদি। 
এসব কথার ওপর ট্যাকসো না ধরে পুরস্কার ঘোষণা করা উচিত। এগুলো হলো লাখ কথার এক কথা। 
বেশি কথা বলার শাস্তি প্রকৃতিই আমাদের দিয়ে থাকে। মধ্যপন্থাই শ্রেষ্ঠ পন্থা। নীরবতা হীরন্ময়। এবং পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখুন।
পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে অনেকেই ভুলে যান। আর পুলিশের সঙ্গে বাক্য বিনিময় করা বা পুলিশের সামনে যুক্তি পেশ করার মতো বোকামিও মানুষ কখনো কখনো করে ফেলতে পারে। কিন্তু তার পরিণতি কী হতে পারে, আমরা তা ভুলে যাই। যেমন ভুলে গিয়েছিলেন একজন বিচারক। তিনি একজন জেলা যুগ্ম দায়রা জজ। তাঁর অপরাধ তিনি নিজ আদালত চত্বরে ঢুকছিলেন। পুলিশ তাঁর ব্যাগ তল্লাশি করতে চায়। বিচারক মহোদয় নিজের পরিচয় দেন। তখন পুলিশ তাঁর আইডি কার্ড দেখতে চায়। তিনি ইতস্তত করছিলেন। হয়তো তিনি বোঝাতে চাচ্ছিলেন যে তিনিই বিচারক, কাজেই তাঁর পরিচয়পত্র দেখানোটা বাহুল্য। তিনি পরিচয়পত্র বের করেন। কিন্তু এই যে বাক্যবিনিময়, যুক্তি খণ্ডন ও পরিবেশন, অর্থাৎ কিনা তর্ক, তা তো পছন্দ নয় আমাদের পুলিশের। অন্য একজন পুলিশ সদস্য তেড়ে আসেন, তর্ক হচ্ছে কেন। পুলিশের হেলমেট আর লাঠির বাড়ি, কিলঘুষি সব পড়তে থাকে এই মাননীয় বিচারকের দেহের ওপর। 
আমরাও তাই বলি। তর্ক হচ্ছে কেন? তর্ক হবে কেন? আমরা তর্ক পছন্দ করি না। 
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Monday, June 4, 2012

পুকুরচুরি বিলচুরি নদীচুরি


পুকুরচুরির গল্পটা আমরা জানি। একটা পুকুর কাটা হবে। বরাদ্দ হলো লাখ টাকা। সেই টাকা ওঠানো হলো। কাজ চলছে, এই রকমই ধারণা কর্তৃপক্ষের। কিন্তু কাজ আসলে হয়নি। এক ফোঁটা মাটিও কাটা হয়নি। তারপর কর্তৃপক্ষ জানাল, পুকুরটা কেমন হয়েছে, দেখার জন্য ইন্সপেক্টর আসছে। তখন এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হলো। পুকুরটা এলাকায় বড় সমস্যা করছে। পচা পানিতে মশা উৎপন্ন হচ্ছে। এটা বোজাতে হবে। আবার লাখ টাকা বরাদ্দ হলো। তারপর একসময় ইন্সপেক্টর এলেন। এসে দেখলেন, কাজ হয়েছে পাকা। পুকুরটা এমন করে ভরাট করা হয়েছে, মনে হচ্ছে এখানে আদৌ কোনো পুকুর ছিলই না।
এটা আগের কালের গল্প। আজকের দিনের গল্প এই রকম হয় না। আগের দিনে এই অভিযোগ উঠত ঠিকাদারের বিরুদ্ধে, কিছুটা প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধেও। আজকের দিনে গল্পটা এই রকম:
এলাকায় একটা পুকুর কাটতে হবে। এলাকার প্রতিনিধি তদবিরে নামলেন। এক কোটি টাকা দরকার। এই প্রকল্প অনুমোদনের জন্য দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবানদের একজনের কাছে যেতে হলো। তিনি বললেন, কী প্রজেক্ট বানায়া আনছেন। গাধা নাকি! এক কোটি টাকায় পুকুর হয়! পাঁচ কোটি টাকার প্রজেক্ট বানান।
প্রতিনিধি সাহেব প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ দেখালেন পাঁচ কোটি টাকা। চার কোটি টাকা ওই বড় ভাই নিয়ে নিলেন। এক কোটি টাকা নিয়ে নিলেন প্রতিনিধি সাহেব। প্রকল্প এলাকায় কেউ গেলেন না। কাগজে-কলমে ওই পুকুর এলাকায় আছে। কেউ জানে না। জানার দরকার পড়ে না।
এই কৌতুকটাই এখন এই দেশে প্রচলিত হয়েছে। সেদিনও একজন কলাম লেখক তা পরিবেশন করেছেন। বাংলাদেশের এক কর্তাব্যক্তি বিদেশে গিয়ে সে দেশের সমপর্যায়ের এক কর্তাব্যক্তির বাড়িতে দাওয়াত খেতে গেলেন। বিশাল প্রাসাদ দেখে তাঁর চক্ষুস্থির। কেমন করে করলে এই বাড়ি? কয় টাকা বেতন পাও? তিনি জানালা দিয়ে দেখিয়ে বললেন, একটা সেতু দেখতে পাও? 
হ্যাঁ।
ওই সেতুর ফিফটি পারসেন্ট দিয়ে এই বাড়ি। 
ফিরতি সফরে সেই বিদেশি কর্তাব্যক্তি বাংলাদেশে এসে বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তির বাড়িতে উঠে একই প্রশ্ন করলেন। এই বাড়ি তো আমারটার চেয়েও বড় আর সৌকর্যময়। কয় টাকা বেতন পাও? করলে কী করে?
দেশি ব্যক্তি বিদেশিকে জানালার কাছে এনে বললেন, নদীর ওপর সেতু দেখতে পাও?
না।
ওই সেতুর হানড্রেড পারসেন্ট দিয়ে এই বাড়ি।
সবচেয়ে মজা হয় নদীতে বাঁধ দেওয়ার জন্য মাটি ফেলার সময়, বালুর বস্তা ফেলার সময়। কত বস্তা ফেলা হলো, আর তা প্রমত্তা নদী ভেঙেচুরে নিয়ে গেল, কে খোঁজ রাখবে। একই গল্প প্রযোজ্য হতে পারে কোনো শুকনো খাল পুনঃখননের বেলাতেও। কতটা মাটি কাটা হলো, কে রাখে তার খোঁজ।
কোম্পানির মাল দরিয়া মে ঢাল। দুর্নীতি সেই কোন অতীত আমল থেকে চলে আসছে এই দেশে। আকবর আলি খান তাঁর পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন এই অঞ্চলে দুর্নীতি কত প্রাচীন। দুই হাজার বছর আগের মনুস্মৃতিতে আছে, ‘প্রজাদের রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে রাজা যাদের নিয়োগ করেন, তারাই ভণ্ডামি করে অন্যদের সম্পত্তি গ্রাস করে। রাজাকে এ ধরনের কর্মকর্তাদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে হবে। রাজার দায়িত্ব হলো যেসব দুষ্ট লোক মামলায় বিভিন্ন পক্ষ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে তাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।’
দুই হাজার বছর আগের চাণক্যের অর্থশাস্ত্রে লেখা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারীরা দুভাবে বড়লোক হয়: হয় তারা সরকারকে প্রতারণা করে, অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে।’ চাণক্য লিখেছেন, আকবর আলি খানের ইংরেজি থেকে অনূদিত বাংলায়, ‘জিহ্বার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব, তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে একটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা। জলে বিতরণরত মাছ কখন জল পান করে তা জানা যেমন অসম্ভব, তেমনি নির্ণয় সম্ভব নয় কখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা তহবিল তছরুপ করে।’
আকবর আলি খান দেখিয়েছেন, বাদশাহি আমলে এই দেশে দুর্নীতি হয়েছে, ব্রিটিশ আমলে হয়েছে। আর এই আমলে?
আমার ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ে। আমাদের পাড়াতেই থাকতেন এমপি সাহেব। আমি তখন হাফপ্যান্ট পরি। মামা চাকরির জন্য দরখাস্ত করবেন। তাঁর দরখাস্তে এমপির সুপারিশ লাগবে। আমি হাফপ্যান্ট পরে চলে গেলাম সকালবেলা এমপি সাহেবের বাসায়, তিনি দরখাস্ত দেখেই হাত বাড়িয়ে তাতে সুপারিশ করে দিলেন। আমিও হাসিমুখে চলে এলাম। এমপি নিয়োগ দিয়ে ঘুষ খান, এমপি স্কুলে ছাত্র ভর্তি করিয়ে ঘুষ খান, এ ধরনের ঘটনা তখন কেউ কল্পনাও করতে পারত না।
আমার খুব দুর্ভাবনা হয়। দুর্নীতির কত ধরনের মুখরোচক গল্প যে শুনি। এই যে ৫০ কোটি টাকার কাজকে ৫০০ কোটি টাকার কাজ বানানোর গল্প শুনি, বাস্তবে তা-ই যদি ঘটে থাকে, তার প্রতিক্রিয়াটা কী হবে? ধরা যাক, সরকার একটা হেলিকপ্টার বা ট্রাক্টর কিনবে। তার দাম ১০ কোটি টাকা। সেটা কেনা হলো ১০০ কোটি টাকা দিয়ে। ৯০ কোটি টাকা চলে গেল কারও পকেটে। আচ্ছা, সেই ৯০ কোটি টাকা তিনি কোথায় রাখেন? ব্যাংকে নাকি বালিশের ভেতরে? ব্যাংকে রাখলে কোন ব্যাংক? দেশি ব্যাংক, নাকি বিদেশি ব্যাংক? নাকি সুইস ব্যাংক?
সরকারের এই টাকা সরকার পায় কোত্থেকে? গরিব মানুষ একটা সিনেমা দেখলে কর দেয়। একটা বিড়ি খেলে তাকে ট্যাক্স গুনতে হয়। আয়কর দেন জনগণ। আমদানি-রপ্তানি কেনাকাটা করতে খাজনা, শুল্ক, কর, ভ্যাট দিতে হয়। তার প্রতিটির প্রভাব পড়ে গরিব জনগণের ওপর। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব। হায়, আমার গরিব দেশের গরিব কৃষক-শ্রমিক খেটে খাওয়া মানুষ! তুমি কি জানো, তুমি নুন খেতে গিয়ে যে কর দিচ্ছ, তা তোমার দেশের রাজরাজড়ারা চুরি করছে!
কোনো পেশার দুর্নীতি নিয়ে দুর্নাম বহু পুরোনো। কাস্টমস, ট্যাক্সে যাঁরা চাকরি করেন, তহসিলদার সাহেব, প্রকৌশলী, দারোগা সাহেব, তাঁদের বাড়িটা পাকা হবে, তা এই দেশের মানুষ বহুদিন থেকে দেখে আসছে। কিন্তু সর্বস্তরে এমন সর্বগ্রাসী দুর্নীতির কথা কি চল্লিশ বছর আগে কেউ ভাবতে পারত?
সর্বস্তরে দুর্নীতি। আগে ছিল পুকুরচুরি, এখন বিল-হ্রদচুরি, নদীচুরি, সমুদ্রচুরি চলছে। দুর্নীতি রাষ্ট্রীয় কেনাকাটায়, লাইসেন্স দিতে, পারমিট দিতে। পুলিশ যদি ধরে তাহলে টাকা, যদি ছেড়ে দেয় তাহলে টাকা। যেখানেই কোনো সরকারি সার্টিফিকেট লাগবে, সেখানেই টাকা। ভাঙা গাড়ি ফিটনেস সার্টিফিকেট পাবে, টাকা থাকলেই। যে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে পারে, টাকা খরচ করলেই। টেলিভিশনের পারমিশন থেকে শুরু করে পরিবেশ ছাড়পত্র, টাকা। নিয়োগের জন্য টাকা। বদলির জন্য টাকা। আর আছে জবরদখল। সরকারি জমি তো দখল হবেই, যেকোনো মানুষের জমি দখল করে টাকা নেওয়া যেতে পারে। নিজের জমিতে বাড়ি করবেন, টাকা গুনুন।
আশ্চর্য নয় যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার আর কোনো কথা বলে না। অথচ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বহুমুখী শক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ক্ষমতাবান লোকেরা প্রতিবছর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করতে বাধ্য থাকবেন। দুর্নীতি, ঘুষ, চাঁদাবাজি ইত্যাদির নির্মূলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সেসব কথা আওয়ামী লীগ ভুলে গেছে। অর্থমন্ত্রী হতাশ, নাহ, আর হলো না।
কত টাকা লাগে একজন মানুষের, এক জীবনে? কেন একজন নেতা দুর্নীতি করবেন? কেন একজন এমপি এলাকার লোকদের কাছ থেকে নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে টাকা নেবেন? 
কোথাও কোনো জবাবদিহি নেই। শুধু বলতে চাই, পাওয়ার করাপ্টস অ্যান্ড অ্যাবসোলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসোলুটলি। ক্ষমতা যত কেন্দ্রীভূত হবে, দুর্নীতি তত বাড়বে। কিন্তু ক্ষমতার শীর্ষ থেকে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতির উন্মুক্ত ও উন্মত্ত চর্চা—আমরা যে অতলে তলিয়ে যাচ্ছি। এখন এই দেশে শিক্ষকেরা পর্যন্ত দুর্নীতি করেন, চিকিৎসকেরা করেন, মাদ্রাসা প্রশাসনে পর্যন্ত দুর্নীতি হয়, আমরা যাব কই।
দুর্নীতি না হলে আমাদের রাস্তাঘাট ভালো থাকত। দুর্নীতি না হলে আমাদের বাস-ট্রেন সুন্দর হতো। দুর্নীতি না হলে আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যেত, সেগুলোর পরিবেশ উন্নত থাকত। দুর্নীতি না হলে মানুষ থানায় গিয়ে ভরসা পেত, বিচার পেত। দুর্নীতি না হলে কৃষক সস্তায় সার পেত, কৃষিপণ্য পেত। দুর্নীতি না হলে মানুষ বিদ্যুৎ পেত। দুর্নীতি না হলে জমিজমা নিয়ে এত মামলা-মোকদ্দমা হতো না। দুর্নীতি না হলে আমাদের ফলে কারবাইড বা ফরমালিন থাকত না, আমাদের নদীতে পানির বদলে আলকাতরা প্রবাহিত হতো না, আমাদের জমিজমা-নদ-নদী রাস্তাঘাট বেদখল হতো না।
আমি জানি না, এই সমস্যার সমাধান কী? আকবর আলি খান লিখেছেন, ‘নিজেদের দুর্নীতি হ্রাসে সরকারি কর্মচারীদের সাধারণত কোনো আগ্রহ থাকে না, তাদের অনেকেই হচ্ছে দুর্নীতির প্রধান পোষক। রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই দুর্নীতি দূর করতে চান। কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের প্রতিরোধের মুখে তাঁরা অকার্যকর, অনেক সময় তাঁরা নিজেরাও একই ব্যাধিতে আক্রান্ত হন।’
আমি তো রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে দুর্নীতি দূর করার কোনো প্রতিজ্ঞা দেখি না। আমরা কি দেশটাকে চুষে শুষে ফুলবনে মত্তহস্তির মতো সবকিছু পায়ে দলে শেষ করে দেব বলেই প্রতিজ্ঞা করে নেমেছি?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।